শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা
রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলায় সাফাতসহ পাঁচজন খালাস

৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা নয়

পর্যবেক্ষণে আদালত | স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে

আদালত প্রতিবেদক

৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের মামলা নয়

খালাস পাওয়ার পর অভিযুক্তরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের পার্টিতে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচজনকে বেকসুর খালাস দিয়েছে আদালত। গতকাল ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক বেগম মোসাম্মৎ কামরুন্নাহারের আদালত এ রায় ঘোষণা করে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলে, ঘটনার ৭২ ঘণ্টা অতিবাহিত হলে পুলিশ যেন ধর্ষণের মামলা না নেয়।

খালাস পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন সাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিম, সাদমান সাকিফ, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন। এদিন কারাগারে আটক পাঁচ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর বেলা ১টা ১০ মিনিটে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। রায় পড়া শেষ হলে ২টা ৫১ মিনিটে এ রায় ঘোষণা করেন। রায় শুনে কাঠগড়ায় থাকা আসামিরা চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’। তারা একে অন্যের সঙ্গে কোলাকুলি করেন। আইনজীবীদের পরামর্শে তারা জোরে সবাইকে সালামও দেন। দুই হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন জানান। এরপর তাদের এজলাস থেকে বের করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। কারাগারে যাওয়ার সময় আসামিরা বলতে থাকেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আমরা নির্দোষ ছিলাম। আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার পেয়েছি।’ ৩ অক্টোবর রাষ্ট্র ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে আদালত রায়ের তারিখ ১২ অক্টোবর ধার্য করে। ওই দিন জামিনে থাকা এ মামলার পাঁচ আসামির জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত। রায় প্রস্তুত না হওয়ায় তা পিছিয়ে ২৭ অক্টোবর ধার্য করা হয়। কিন্তু প্রবীণ আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদারের মৃত্যুতে নিম্ন আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তা পিছিয়ে ১১ নভেম্বর ধার্য করা হয়। এর আগে ২৯ আগস্ট আত্মপক্ষ শুনানিতে সাফাতসহ পাঁচজনই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভিকটিমদের ডাক্তারি রিপোর্টে কোনো সেক্সুয়াল ভায়োলেশনের বিবরণ নেই। ভিকটিমের পরিধেয়তে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মিলল না। ৩৮ দিন পর এসে তারা বলল “রেপড হয়েছি”। বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল।’ তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের ‘পাবলিক টাইম নষ্ট’ করেছেন পর্যবেক্ষণ দিয়ে বিচারক বলেন, পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে কোনো ধর্ষণের মামলা না নেয়। বিচারক রায় পড়ার সময় বলেন, ‘আপনারা বলছেন এটি একটি আলোচিত মামলা, কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে না। আমার কাছে সব মামলাই আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ। এ মামলাটির মেডিকেল রিপোর্টে কিছুই পাওয়া যায়নি এবং ডাক্তাররা কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি।’ রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘মামলার দুই ভিকটিম আগে থেকেই সেক্সুয়াল কাজে অভ্যস্ত। তারা স্বেচ্ছায় হোটেলে গিয়েছেন। সেখানে গিয়ে সুইমিং করেছেন। ঘটনার ৩৮ দিন পর তারা বললেন “আমরা ধর্ষণের শিকার হয়েছি”। অহেতুক তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছেন। এতে আদালতের ৯৪ কার্যদিবস নষ্ট হয়েছে। এর পর থেকে পুলিশকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছি। এ ছাড়া এর পর থেকে ধর্ষণের ৭২ ঘণ্টা পর যদি কেউ মামলা করতে যায় তা না নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি।’ মামলার পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘ঘটনার ৩৮ দিন পর মামলা ফাইল করা হয়। ৩৯ দিন পর করা হয় মেডিকেল। ভিকটিমদের পোশাকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। ধর্ষণ প্রমাণে মেডিকেল লাগে তা-ও প্রমাণিত হয়নি। বীর্যের উপস্থিতিও পাওয়া যায়নি। ভিকটিমরা স্বেচ্ছায় সেখানে গিয়ে ইচ্ছা করে আসামিদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়ান। এর ৩৮ দিন পর আসামি সাফাত আহমেদের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার প্ররোচনায় মামলা করেন তারা। ধর্ষণের উপাদান না পাওয়ার পরও পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে অহেতুক ট্রায়ালে পাঠায়। মামলাটির বিচারকাজ এ আদালতে চলেছে ৯৩ কার্যদিবস। আজ ৯৪তম কার্যদিবস। এতে আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে। মামলায় যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আগে থেকেই ভিকটিমরা ফিজিক্যাল রিলেশনে অভ্যস্ত ছিল। তারা তাদের বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশনে যায়। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। কাজেই আসামিদের খালাস দেওয়া হলো।’ ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে অস্ত্রের মুখে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ৬ মে বনানী থানায় পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই বছরের ৭ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) পরিদর্শক ইসমত আরা এমি পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করেন। ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। ২২ আগস্ট মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়। চার্জশিটভুক্ত ৪৭ সাক্ষীর মধ্যে ২২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।

 

সর্বশেষ খবর