বৃহস্পতিবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়ার প্রতি মানবতা দেখিয়েছি

নিজস্ব প্রতিবেদক

খালেদা জিয়ার প্রতি মানবতা দেখিয়েছি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আমার অথরিটিতে বাসায় থাকতে দিয়েছি। আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার সেটুকু দেখিয়েছি। অমানবিক একজনকে আমি মানবতা দেখিয়ে বাসায় থাকতে দিয়েছি। বাকিটা আইনের ব্যাপার।

যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন (কপ২৬) ও ফ্রান্স সফর শেষে গতকাল বিকালে গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। গণভবনে সম্পাদক, সিনিয়র সাংবাদিক ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আমন্ত্রিত সাংবাদিকরা ভার্চুয়ালি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা  জিয়াকে যে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি না? আপনাকে যদি কেউ হত্যা করার চেষ্টা করত, আপনি কি তাকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন? বা আপনার পরিবারকে যদি কেউ হত্যা করত, আর সেই হত্যাকারীদের বিচার না করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিত, তাদের জন্য আপনি কী করতেন? তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইলেকশনে হত্যাকারীকে পার্লামেন্টে বসানো হয়। যেখানে আমি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলাম, সেখানে বসানো হলো খুনি কর্নেল রশীদকে। কে করেছিল? খালেদা জিয়া। খায়রুজ্জামান আসামি, তার মামলার রায় হবে। চাকরি নাই। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে সেই আসামিকে চাকরি দিলেন ফরেন মিনিস্ট্রিতে। অ্যাম্বাসাডর করে পাঠালেন। পাশা (মেজর পাশা) একজন খুনি। সে সেনাবাহিনীর অফিসার ছিল। মারা গেছে। ক্ষমতায় এসে মৃত ব্যক্তিকে প্রমোশন দিয়ে তার অবসর ভাতা-টাতা সব দিয়ে দিল। আর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর বলে দিল কী! আমি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে আত্মহত্যা করতে নিজেই নিজেকে গ্রেনেড মেরেছিলাম। তিনি বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ২২ জন মারা গেছেন। একদিন পার্লামেন্টে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে দেয়নি। এত বড় অমানবিক যে তাকেই আমি মানবতা দেখিয়েছি। আমার হাতে যেটুকু পাওয়ার সেটুকু দেখিয়েছি। আর কত চান?

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটালীপাড়ায় বোমা যখন পোঁতে, তার আগে তার (খালেদা জিয়া) বক্তৃতা কী ছিল- শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধীদলীয় নেতাও হতে পারবেন না। বলেছিল কারণ, মরেই তো যাব। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে! এত কিছুর পরও খালেদা জিয়ার প্রতি দয়া দেখাতে আপনারা বলেন! কেউ এ প্রশ্ন করলে আমার মনে হয় আপনাদের একটু লজ্জা হওয়া উচিত- এই কথাটা অন্তত আমাকে বলার...। যারা আমার বাপ-মা, ভাই-বোন... এমনকি আমার ছোট ভাই রাসেলকে পর্যন্ত হত্যা করিয়েছে। তার পরও আমরা অমানুষ না। অমানুষ না দেখেই আমার এক্সিকিউটিভ অথরিটি আমার হাতে যতটুকু আছে ততটুকু দিয়েই তাকে বাসায় থাকার, চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বাকিটা আইনগত ব্যাপার। তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়াও দুর্নীতি করে করে এ দেশটাকে একেবারে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে।

গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব উপস্থিত ছিলেন।

সামরিক আদালতে সৈনিক-মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় গুরুত্ব দিয়ে দেখবে সরকার : জিয়াউর রহমানের সামরিক আদালতের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সামরিক আদালত বসিয়ে সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের পর প্রতিটি ক্যুতে সেনাবাহিনীর হাজার হাজার অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত ছিল। তার নির্দেশে প্রহসনের বিচারের জন্য সামরিক আদালত বসানো হয়েছিল। কত মানুষ মারা গিয়েছিলেন তার প্রকৃত সংখ্যা বের করা যায়নি। তিনি বলেন, ’৭৫-পরবর্তী সময়ে অনেক সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। সেসব সেনা কর্মকর্তার স্বজনদের খোঁজ নেবে সরকার। দাবি যেহেতু উঠছে আমি মনে করি এটা নিয়ে কাজ করা উচিত। আপনারা যেহেতু এটি বলছেন, সরকার এটি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।

১৫ আগস্ট স্বজন হারানো পরিবারগুলোকে মামলা করারও সুযোগ দেওয়া হয়নি জানিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আরও বলেন, আমার বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যাকান্ডে আমি মামলা করতে পারিনি। মামলা করতে দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমি অনেক পরিবারের কাছে গিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের আর্তনাদ শুনেছি। ১৯৭৭ সালে কারাগারে কত মানুষ হত্যা করা হয় তা এখনো কেউ জানে না। এগুলো নিয়ে কেউ এত দিন কথা বলেনি। এখন আপনারা এটি নিয়ে কথা বলছেন, এটা ভালো। আমি নিজেও তো এ ধরনের ক্যুর ভুক্তভোগী।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিটিভিতে চারজনকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই সময় আমার ফুফাতো ভাই ফিরোজ কবির চৌধুরী, যিনি ক্যামেরাম্যান ছিলেন তাকেও হত্যা করা হয়। ওই সময় তাদের হত্যা করে বিলের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। জেলখানায় যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদের হয়তো খোঁজ পাব।

দলীয় প্রতীকের কারণে সংঘাতের অভিযোগ ঠিক নয় : ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দেওয়ার সম্ভাবনা নাকচ করে সহিংসতার জন্য বিএনপিকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মুশকিল হচ্ছে এখানে আমরা শুধু চেয়ারম্যান পদে প্রতীক দিচ্ছি, কিন্তু মেম্বার পদে কোনো প্রতীক নেই। তাদের কোনো প্রতীক থাকে না। আপনারা যদি ঘটনাগুলো দেখেন মেম্বারদের মধ্যেও গোলমাল, তাদের মধ্যেও কাটাকাটি। শুধু যে চেয়ারম্যান প্রতীক দিচ্ছি দেখেই মারামারি তা কিন্তু না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচনী সহিংসতা অনেক কমিয়ে আনা হয়েছে। তবে এটা ঠিক, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংসতা আগেও হয়েছে। এখনো হোক সেটা চাই না। হানাহানি, ভোট দিতে গিয়ে মানুষের প্রাণ যাবে এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

বিএনপিসহ বিভিন্ন দল দলীয়ভাবে নির্বাচন না করলেও তাদের নেতারা যে অনেক জায়গায় স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করছে, সে বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, তৃণমূলে দেখা যায় একজনকে নমিনেশন দেওয়া হয়েছে, অনেকের আকাক্সক্ষা থাকে। নির্বাচন তো সবাই করছে, আমরা যেমন আওয়ামী লীগের নামে করছি, বিএনপি নাম ছাড়া করছে, অন্যান্য দলও করছে। এই যে হানাহানি, মারামারি, কোথায় কোথায়, কাদের মধ্যে হচ্ছে সেটা আপনারা দেখেন। আমাদের দলের মধ্যে যেগুলো হবে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। শুধু ব্যবস্থা না, আমরা যাদের মনোনয়ন দিয়েছি তাদের বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচন করেছে, যতই ভালো প্রার্থী হোক যারাই দলের বাইরে গিয়ে কাজ করেছে, আমরা কিন্তু যথাযথ ব্যবস্থা নেব। আমরা কিন্তু ছাড়ব না। তিনি বলেন, কিন্তু এদের (আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী) বাইরে যারা নির্বাচনে হানাহানি করল, এখন তো তারা দলীয়ভাবে নির্বাচনে আসছে না, সেদিক দিয়ে তারা চালাকিটা ভালোই করল। নির্বাচনও করছে, মারামারিও করছে। উসকেও দিচ্ছে, আবার বিজয়ীকে সমর্থন দিয়ে আরেকটা মারামারি বাধিয়ে দিচ্ছে। কাজেই সেটাও দেখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোনো প্রাণহানি হোক এটা আমরা কখনো চাই না। এটা হওয়া উচিত না। এটা যেখানে যেখানে ঘটেছে, সেখানে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, সেটা কিন্তু আমরা রক্ষা করে যাচ্ছি।

ডিজেলে প্রতি বছর ২৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার : সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, জিনিসপত্রের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। উৎপাদন বাড়ানোর সব ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। আমাদের তেল কিনে আনতে হয়। প্রতি বছর ২৩ হাজার কোটি টাকা ডিজেলে ভর্তুকি দিতে হয়। বিদ্যুৎসহ সব মিলিয়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকি। কৃষকের জন্য সারের দাম আমরা কমিয়েছি। যে সার ৯০ টাকা ছিল তা কমিয়ে ১৫-১৬ টাকা করেছি। কৃষিতে প্রতিটি ক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছি। কার্ড করে দিয়েছি। এখন কৃষক ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে। যার মাধ্যমে ভর্তুকির টাকা সরাসরি তাদের কাছে যায়।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়া এবং দেশে জ্বালানি তেলে ভর্তুকির বিষয় তুলে ধরে তিনি বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাসের ভাড়া একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, বাস্তবতা বুঝতে হবে। মানুষের যেন খাদ্যের কষ্ট না হয় সেদিকে আমাদের নজর আছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘদিন করোনার কারণে বাস-লঞ্চ এসব চলাচল বন্ধ ছিল। যারা এ ব্যবসা করেন তাদেরও তো কষ্ট ছিল, তাদেরও লোকসান ছিল। প্রণোদনা দিয়ে তাদের ব্যবসা যেন চালু থাকে সে ব্যবস্থা নিয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই যখন তেলের দাম বেড়েছে তারাও সুযোগ নিয়েছে দাম বাড়ানোর। তাদেরও দাবি ছিল। আমার সঙ্গে আলোচনা চলেছে। সব সময় যোগাযোগ ছিল। তাদের সঙ্গে বৈঠক ও আলোচনার মাধ্যমে একটা সমঝোতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাসের ভাড়া একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে বলেন, আপনারাই বলেন, কত টাকা ভর্তুকি দেওয়া যাবে? তাহলে আমরা সেভাবে ভর্তুকি দেব। বাজেটের সব টাকা আমরা ভর্তুকিতেই দিয়ে দেব। পরবর্তীতে দেশের আর কোনো উন্নয়ন হবে না কিন্তু সেটাও দেখতে হবে। অনেক উন্নত দেশে খাদ্যের জন্য হাহাকার করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, লন্ডনে সুপার মার্কেটে সাপ্লাই নেই। খাবার জিনিস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তবে বাংলাদেশে কোনো খাদ্যের হাহাকার নেই।

সবাই উপার্জন করে, ট্যাক্স কতজন দেয় : দেশে অনেকে ট্যাক্সের টাকা ফাঁকি দেওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সবাই টাকা উপার্জন করে, ট্যাক্স কতজন দেয়? আমাদের চাল, ডাল, বাড়ি-গাড়ি সবই আছে। তার পরও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার দিকে নজর এবং এটাই বাস্তবতা। সরকারের টাকা আসবে কোথা থেকে? এখন বিদ্যুৎ সবার ঘরে ঘরে। এখানেও ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলতে পারছি না।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে যা বললেন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি সেটা কিন্তু আমরা রক্ষা করে যাচ্ছি। আমরা বলেছি যে বিচারবহির্ভূত হত্যা হবে না, সেটা হচ্ছে না। কিন্তু ঘটনাচক্রে কিছু কিছু ঘটনা যখন ঘটে যায় তখন সঙ্গে সঙ্গে সেটার তদন্ত হয়। অন্যায়ভাবে যদি কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করে র‌্যাবই হোক আর পুলিশই হোক, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের বিচারও হচ্ছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, একেবারে টোটাল বন্ধ করে দেওয়া, এটা পৃথিবীর কোনো দেশেই হচ্ছে না। আপনি আমেরিকার দিকে তাকান তো। একটা বাচ্চা ছেলে, পকেটে শুধু হাত রাখল আর পুলিশ গুলি করে মারল। আরেকটা যে পুলিশ গলায় পাড়া দিয়ে মেরে ফেলে দিল। সেগুলো কি বিচারবহির্ভূত হত্যা না? লন্ডনে সেদিন যে একজন এমপি তার অফিসে বসে ছিল। সে ৪৫ বছর ধরে সেখানে এমপি। সেখানে ঢুকে ছুরি মেরে ফেলে দিল।... কী বলবেন সেখানে? কই, সেখানে তো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা থেকে শুরু করে কাউকেই তো সোচ্চার হতে দেখি না। তিনি আরও বলেন, আমেরিকার মতো জায়গায় একজন মুক্তিযোদ্ধা বেড়াতে গেছেন আত্মীয়বাড়িতে। তাকে সবাই নিয়ে গেছেন মসজিদে। তিনি মসজিদের ইমামতি করে ফিরে আসছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হলো। এ ঘটনাগুলোর সঙ্গে আপনারা বাংলাদেশের তুলনা করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকার মতো বিশাল দেশ। বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা তার দ্বিগুণ জনসংখ্যা। বাংলাদেশ ওদের একটা ছোট অঙ্গরাষ্ট্রের সমান একটা দেশ। তাদের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি আমাদের এখানে। যেখানে এ রকম একটা ঘনবসতিপূর্ণ জায়গা। তার পরও আমরা আমাদের আইনশৃঙ্খলা অনেক নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। ঘটনা যেগুলো ঘটে সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যবস্থা কিন্তু নিই। কাজেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হতে দেখেন না, এ কথাটা বললে ভুল বলবেন।

বিশ্বকাপ নিয়ে আমি হতাশ নই, আপনারা কেন : আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্সে হতাশার কিছু নেই জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যেটা আশা করেছিলাম আমাদের খেলোয়াড়রা তা খেলতে পারেনি। তাই বলে আমি কিন্তু আমাদের ছেলেদের কখনো হতাশ করিনি। আমি তাদের বলি, আরও ভালো খেল। আরও মনোযোগী হও, আরও অনুশীলন কর। করোনার কারণে তারা অনুশীলন করতে পারেনি। তার পরও বাংলাদেশ আজ বিশ্বকাপে খেলছে, বেশ কয়েকটি দেশকে হারাতে পেরেছে, এটাই তো বড় কথা।

টাইগারদের হারে সমর্থকদের দ্রুত হতাশ না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা আরও বলেন, আমি চাচ্ছি তাদের আরও বেশি অনুশীলন করানো। আরও ভালো যেন খেলতে পারে সে ব্যবস্থা করা। সুতরাং কথায় কথায় এত হতাশ হওয়া তো ঠিক নয়। এটাই আমাদের একটা মানসিক সমস্যা হয়ে গেছে। এতটুতেই হতাশ। বেশি হতাশ হওয়া যাবে না। মাঝামাঝি থাকতে হবে। ভবিষ্যতে টাইগাররা ভালো করবেন এমন আশা ব্যাক্ত করে তিনি বলেন, আগামীতে নিশ্চয়ই (ক্রিকেটাররা) ভালো করবে। নতুন প্রজন্ম আসছে, তারা ভালো করছে।

জলবায়ু ক্ষতিপূরণ ত্বরান্বিত হওয়া বড় প্রাপ্তি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এবারের কপ সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি হচ্ছে বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা প্যারিস চুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়সহ জলবায়ু অর্থায়ন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে একমত হন। বাংলাদেশসহ ১৪১টি দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের অরণ্য নিধন রোধে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়সহ জলবায়ু অর্থায়ন-প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের একমত হওয়াকে এবারের জলবায়ু সম্মেলনের বড় প্রাপ্তি বলে মনে করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সংবাদ সম্মলনের সূচনা বক্তব্যে শেখ হাসিনা বলেন, যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম বিবিসি সম্প্রতি তাদের একটি প্রতিবেদনে আমাকে কপ২৬ সম্মেলনের পাঁচজন শীর্ষ ডিল মেকারের একজন হিসেবে চিহ্নিত করে। একে আমি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন, আমাদের নৈতিক পররাষ্ট্রনীতির প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থা হিসেবে বিবেচনা করে সম্মানিত বোধ করি।

ভ্যাকসিন নিয়ে অসুবিধা হবে না : এখন পর্যন্ত দেশের ৮ থেকে ৯ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ২৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কেনা হয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ভ্যাকসিন নিয়ে আমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। কেউ ভ্যাকসিন থেকে বাদ যাবে না। তিনি বলেন, ভ্যাকসিন অনেক দাম দিয়ে কিনতে হয়। ২৫ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনেছি। শুধু করোনার টেস্ট বাবদ খরচ হয় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে ৮-৯ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৪ কোটি মানুষকে ডাবল ডোজ দেওয়া হয়েছে। বাকিদের প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। পেশাজীবী, শ্রমিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাইকে টিকা দেওয়া হচ্ছে। কেউ ভ্যাকসিন থেকে বাদ যাবে না।

বিএনপির নির্বাচন করার সাংগঠনিক শক্তি ও জনপ্রিয়তা নেই : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বিএনপি ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতা ছাড়া টিকে থাকার যোগ্যতা তাদের নেই। এখন নির্বাচন করবে সেই সাংগঠনিক যোগ্যতাও তাদের নেই। সে কারণে তারা চালাকি করে প্রতীক ছাড়া ভোট করছে। জনগণ আওয়ামী লীগকে চায়। সে কারণে আওয়ামী লীগকেই ভোট দিচ্ছে। তিনি বলেন, বিএনপির কাজই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা। তাই দেশের অর্থ পাচার করে তারা দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে। অর্থ দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। বিগত সময়ে তারা আগুনসন্ত্রাস করে মানুষ হত্যা করেছে। এখন দেশের মধ্যে অশান্তির জন্য বিভিন্ন মন্দিরে হামলা, প্রতিমার পায়ে পবিত্র কোরআন রাখল কারা? সেসব তথ্য বের হচ্ছে। সিসি ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচারক নিয়োগ হয় জুডিশিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে। তারা মেধা ও যোগ্যতার মাধ্যমেই নিয়োগ পান। আর বিচারক নিয়োগ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে। আমার কোনো ক্ষমতা নেই।

উত্তরাধিকার আইন নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জমিজমা ভাগ করার সময় সবাই শরিয়ত আইন মানেন। দাদার সম্পত্তিতে পুরো ভাগ না হলেও বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের সমঅধিকার দেওয়া উচিত। বিষয়টি সবাইকে ভেবে দেখতে হবে।

সংসদে প্রধানমন্ত্রী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের উন্নয়নে দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও আনুগত্য আবশ্যক। দেশের উন্নয়ন করতে হলে নিষ্ঠাবান হতে হবে, দেশপ্রেম থাকতে হবে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা নিয়ে কাজ করলেই উন্নয়ন হতে পারে। সততা ছাড়া যে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে গতকাল জাতীয় সংসদের ১৫তম অধিবেশনের চতুর্থ দিনে সদ্যপ্রয়াত এমপি মো. একাব্বর হোসেনের মৃত্যুতে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, টানা ১২ বছরের শাসনে দেশের যে উন্নতি সেটা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ না করলে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এ সময় মরহুম একাব্বর হোসেনের সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুধু মির্জাপুর বা টাঙ্গাইলের উন্নয়ন নয়, আমাদের দেশের অবকাঠামো উন্নয়নে এবং সড়ক ও সেতু নির্মাণে যে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি সেখানেও একাব্বর হোসেনের একটা সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। অসুস্থ অবস্থায় সংসদের এই সেশনেও তাঁর কমিটির একটি বিল সংসদে উত্থাপন এবং পাস হয়।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিজের দেশের অর্থ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে সেই অর্থ থেকে আবার কমিশন গ্রহণের নজিরও অতীতে দেশে ছিল। কিন্তু একাব্বর হোসেন এত উন্নয়ন কাজ করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। এটা বিরল। তিনি বলেন, তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের জন্য এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি। কেননা একাব্বরের মতো একজন নিষ্ঠাবান ও সৎ রাজনীতিবিদকে আমরা হারালাম। কাজেই সেই ধরনের নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব যে দেশের জন্য কতটা প্রয়োজন সেটা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন বলেও উল্লেখ করেন।

আগামী জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু হবে : জাতীয় পার্টির সৈয়দ আবু হোসেনের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ভায়াডাক্টসহ ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বাংলাদেশের দীর্ঘতম পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ চলছে। পদ্মা সেতুর ভৌত অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগব্যবস্থা দ্রুত ও সহজতর হবে। এটি এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও যুক্ত হবে, যা প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করবে। আগামী জুনের মধ্যে স্বপ্নের এ সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের নির্মাণকাজও এগিয়ে চলেছে। অক্টোবর ২০২১ পর্যন্ত ৭৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ঢাকা শহরে সাবওয়ে (আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো) নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে। অক্টোবর পর্যন্ত সমীক্ষা প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার মাধ্যমে অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করে যথাসময়ে সাবওয়ে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে বলে আশা করা যায়।

সর্বশেষ খবর