শিরোনাম
রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সাইনবোর্ডেই থাকল ক্রিকেট স্টেডিয়াম

অনুমোদনে পার হয়েছে ২০ বছর, সিদ্ধান্তহীনতা নানামুখী টালবাহানা চলছেই

মেজবাহ্-উল-হক

সাইনবোর্ডেই থাকল ক্রিকেট স্টেডিয়াম

শুধু সাইনবোর্ডই রয়েছে, বাস্তবায়ন হয়নি স্টেডিয়াম -বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিশাল আকারের নৌকা। পেটের ভিতর নয়নাভিরাম একটি সবুজ ক্রিকেট স্টেডিয়াম, যেখানে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে নামবে দুই দল। নকশা অনুযায়ী এটিই হচ্ছে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম। নৌকার আদলে বলে নাম ‘দ্য বোট’। কিন্তু স্বপ্নের এই স্টেডিয়াম এখনো সাইনবোর্ড ও নকশাতেই আটকে আছে। বাস্তবে স্টেডিয়ামের কোনো কাজই শুরু হয়নি। দুই বছর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) স্টেডিয়াম তৈরির দায়িত্ব নিলেও কোন প্রতিষ্ঠান (কনসালট্যান্সি ফার্ম) এই স্টেডিয়ামের কাজ করবে তা চূড়ান্ত হয়নি। সিদ্ধান্তহীনতা ও নানামুখী টালবাহানা চলছেই। অনুমোদনের পর ২০ বছর ধরে স্টেডিয়ামের জমি কেবল হাতবদল হচ্ছে। প্রথমে স্টেডিয়াম তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, সেখান থেকে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় হয়ে এখন দায়িত্ব পেয়েছে বিসিবি।

গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পূর্বাচল প্রকল্পের ১ নম্বর সেক্টরে ৩০০ ফিট রাস্তার পাশেই বড় আকারের এই সাইনবোর্ড, যেখানে লেখা ‘শেখ হাসিনা ক্রিকেট স্টেডিয়াম’। ধুলা জমে থাকায় লেখাগুলো ঠিকঠাক বোঝা যায় না। সেখানে প্রায় ৩৮ একর জমি টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। ভিতরে নানা প্রজাতির গাছ আর লতাপাতায় পূর্ণ। এক পাশে বিসিবির প্রকল্প অফিসের জন্য ছোট্ট ভবন। অন্য পাশে প্রস্তুত করা হচ্ছে একটি মাঠ। দুটি উইকেটও বানানো হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে একটি ড্রেসিংরুমও। তবে এগুলো মূল স্টেডিয়ামের নকশার মধ্যে নেই। যেহেতু জায়গা পড়ে আছে তাই সাময়িকভাবে একটি ভেন্যু তৈরি করা হচ্ছে, যাতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ক্রিকেটের কিছু ম্যাচ আয়োজন করা যায়। কিন্তু মূল স্টেডিয়াম তৈরির কাজ এখনো শুরুই হয়নি। এমনকি কাজ শুরুর কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।

কেন শেখ হাসিনা স্টেডিয়াম তৈরির কাজ এখনো শুরু হচ্ছে না- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গতকাল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বলেন, ‘স্টেডিয়াম তৈরির দায়িত্ব এখন আমাদের নয়। এ দায়িত্ব বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের। আমরা জমিটি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ইজারা নেওয়ার পর নিজেরাই স্টেডিয়াম তৈরি করতে চেয়েছিলাম। দরপত্র আহ্বানেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু পাপন ভাই (নাজমুল হাসান পাপন, সভাপতি, বিসিবি) অনুরোধ করেন, স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজটি যেন বিসিবির দায়িত্বে দেওয়া হয়। আমরা সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে আলোচনা করে দায়িত্ব বিসিবিকে হস্তান্তর করি। এখন স্টেডিয়াম বানানোর দায়িত্ব তাদের। তবে যেহেতু বিসিবিও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে, তাই আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত দেখব। যদি এর মধ্যে কাজ শুরু না হয়, তখন আমরা ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে কথা বলব।’

জমি বুঝে পাওয়ার পর দুই বছর পার হয়ে গেলেও কেন স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে গতকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দীন চৌধুরী সুজন বলেন, ‘দুই বছর আগে আমরা যখন জমি বুঝে পাই, ইচ্ছা ছিল তিন-চার বছরের মধ্যেই কাজ শেষ করব। কিন্তু এরপর তো করোনা মহামারীর কারণে দুই বছর কোনো কাজই করতে পারিনি। আমরা বিদেশি যেসব প্রতিষ্ঠানের (কনসালট্যান্সি ফার্ম) সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তারা আসতে রাজি হয়নি। তবে এখন তাদের সঙ্গে আবার কথা হচ্ছে। আমরা ২৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে ১০টি নির্বাচন করেছি। এর মধ্য থেকে দ্রুতই ৫টি কোম্পানিকে ডাকব। সেখান থেকে একটি কোম্পানিকে কাজ দেব। তারাই আমাদের স্টেডিয়ামটি তৈরি করবে।’

কবে স্টেডিয়াম তৈরির কাজ শুরু হবে, কিংবা কবে শেষ হবে তা পরিষ্কার করে বলতে পারেননি বিসিবির প্রধান নির্বাহী। নিজামউদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘কনসালট্যান্সি ফার্ম চূড়ান্ত করা হলে তারাই বলতে পারবে কত দিন লাগবে। আগে থেকেই আমরা কিছু বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা থাকবে যত দ্রুত সম্ভব তৈরি করা। আমরা নৌকার আদলটি দেব। এটা আসলে কনসেপচুয়াল ডিজাইন। এটা ঠিক রেখে চূড়ান্ত নকশাটা তারাই তৈরি করবে। তবে আশা করি কয়েক বছরের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন হবে। আর এই স্টেডিয়ামটি হবে সম্পূর্ণ বিসিবির অর্থায়নে।’

এর আগে বিসিবি স্টেডিয়ামটি নির্মাণের জন্য একটি বাস্তবায়ন কমিটি করেছিল। সেই কমিটিতে ছিলেন বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুস। তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব কোম্পানিকে কাজ করার জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় রেখেছি, তারা ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কাতারের বিখ্যাত স্টেডিয়ামগুলো বানিয়েছে। কেউ আছে তারা অলিম্পিক স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে। এটুকু বলতে পারি, বিশ্বের সেরা কোম্পানিকে দিয়েই আমরা এশিয়ার সেরা স্টেডিয়াম তৈরি করব।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আগেই জানিয়েছে, স্টেডিয়ামটি হবে অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন। এখানে থাকবে বিসিবির প্রধান কার্যালয়। এটি হবে সম্পূর্ণ একটি স্পোর্টস কমপ্লেক্স, যেখানে মূল স্টেডিয়ামের পাশাপাশি থাকবে অনুশীলনের জন্য দুটি বড় মাঠ। থাকবে একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমি, যেখানে উদীয়মান ক্রিকেটার তৈরি হবে। এ ছাড়া ইনডোর, সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম তো থাকবেই। মূল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে একসঙ্গে ৫০ হাজার দর্শক বসে খেলা দেখতে পারবেন। স্টেডিয়ামটি ১৫-২০ বছরের মধ্যে সংস্কারের প্রয়োজন পড়বে না। তবে চাইলে বাড়ানোর সুযোগ থাকবে আসন সংখ্যা। এমন স্টেডিয়ামের সঙ্গে একটি পাঁচ তারকা হোটেল বানানোর পরিকল্পনাও আছে, যাতে ক্রিকেটারদের বাইরে আর থাকতে না হয়।

কিন্তু এ সবই তো কল্পনা। বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজটি এখনো শুরুই করতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। ২০৩১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আয়োজক ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশ। এখনো ১০ বছর বাকি। বিসিবি স্বপ্ন দেখছে শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামেই হবে বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। তাহলে কি স্টেডিয়ামের কাজ সম্পন্ন হতে আর ১০ বছর লাগবে? বিসিবি প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘না, অত দিন পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব না। এর অনেক আগেই শেষ করার চিন্তা আছে। ২০৩১ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে এশিয়া কাপ আছে। এ ছাড়া আরও কিছু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের চেষ্টা চলছে। আমাদের চেষ্টা থাকবে সেই টুর্নামেন্টগুলো এ স্টেডিয়ামে আয়োজন করার।’

শেখ হাসিনা স্টেডিয়ামটি তৈরির কথা ছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের। ২০০০ সালের দিকে স্থান নির্বাচন করে স্টেডিয়ামের জন্য জমি অধিগ্রহণও করে। কিন্তু স্টেডিয়াম আর তৈরি হয়নি। এর বছর দশেক পর ক্রীড়া মন্ত্রণালয় দায়িত্ব নেয়। সব শেষ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে স্টেডিয়াম তৈরির দায়িত্ব গ্রহণ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।

বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে লড়াই করলেও বিসিবির নিজস্ব কোনো স্টেডিয়াম নেই। এমনকি বিসিবির প্রধান কার্যালয়ও ভাড়া করা জায়গায়। এ জন্য ক্রিকেট বোর্ড নিজস্ব অর্থায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে একটি স্টেডিয়াম বানানোর জন্য দুই বছর আগে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ৩৮ একর জমি ইজারা নেয়।

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (ক্রীড়া) শাহ আলম বলেন, ‘আমরা প্রায় ১০ বছর আগে ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে এই জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দিই। চুক্তি হয়েছিল ১০ বছরের মধ্যে স্টেডিয়ামের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এখন ক্রীড়া মন্ত্রণালয় বিসিবির কাছ থেকে বুঝে নেবে কবে নাগাদ এই স্টেডিয়ামের কাজ শেষ হবে।’

যুব ও ক্রীড়া সচিব আক্তার হোসেন স্টেডিয়াম তৈরির ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। এটা ক্রিকেট বোর্ড জানে। কারণ বিসিবিকে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

এখন দেখার বিষয়, কবে নাগাদ শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের কাজ শুরু হয়।

সর্বশেষ খবর