রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ড্যাপ বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ড্যাপ বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ

ঢাকা মহানগর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, আমলা, ব্যবসায়ী নেতা ও অংশীজনেরা। সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, সবাইকে নিয়ে নির্ভুলভাবে ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে চাই। এলজিআরডি মন্ত্রী বলেছেন, সম্মিলিতভাবে ড্যাপ নিয়ে কাজ করতে পারলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে। আর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বলেছেন, ড্যাপ চূড়ান্ত না হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। বিএলডিএ সভাপতি বলেছেন, দেশ, জাতি ও বিনিয়োগের জন্য ড্যাপ জরুরি। সময় ক্ষেপণ না করে যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপ প্রস্তাব আকারে অনুমোদন দিন। পরে প্রয়োজন অনুযায়ী রিভিও কমিটির মাধ্যমে সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্তনসহ সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যাবে। অন্যদিকে রিহ্যাব সভাপতি বলেছেন, নির্বাচনের আগে ড্যাপ জনগণকে কী বার্তা দেবে তা-ও সরকারকে ভাবতে হবে। অংশীজনদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেছেন, রাজউকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সমঝোতা অনুযায়ী অংশীজনদের মতামতের কাক্সিক্ষত প্রতিফলন এ ড্যাপে নেই।

গতকাল রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) আয়োজিত ড্যাপ (২০১৬-২০৩৫) খসড়া পরিকল্পনা নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সেমিনারের বক্তারা এসব কথা বলেন। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী ও ড্যাপ রিভিউ-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক মো. তাজুল ইসলাম। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ এমপি, স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন-বিএলডিএ সভাপতি ও দেশের শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তা পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান, রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজলসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনেরা। সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য দেন রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী আর মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) বাস্তবায়নে আপনারা একটি সুন্দর পরিকল্পনা দিয়েছেন তার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। আমার আরেকটা বিষয় ভালো লেগেছে। আপনারা সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসেন। সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাকে আমরা বাধাহীন করার কাজ করছি। পৃথিবীর অনেক দেশের সিটি করপোরেশনের আয় বেড়েছে। তারা মেট্রোরেল বানিয়েছে। বিমানবন্দর বানিয়েছে, খেলার মাঠ, পার্ক করেছে। আমাদের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে ক্যাপাসিটি ডেভেলপ করতে হবে। দেশের উন্নতির জন্য সবাইকে অনিবার্য মনে করতে হবে। আমরা কারও পক্ষের নই, কেউই আমাদের শত্রুও নয়। আহ্বায়ক হওয়ার পর সবার মতামত শোনার চেষ্টা করেছি। সবাইকে নিয়ে কাজ করতে চাই। আমরা সবাই মিলে সম্মিলিতভাবে ড্যাপ নিয়ে কাজ করতে পারলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে।’

সালমান এফ রহমান এমপি বলেন, ‘ড্যাপের বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাস্তবায়নে। আশা করি ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে পারব। রাজধানীকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। অংশীজনদের যৌক্তিক যে কোনো প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়া হবে বলে মন্ত্রী আমাকে নিশ্চিত করেছেন। ড্যাপ চূড়ান্ত না হওয়ার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। জানুয়ারিতে এটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। রাজউকের বিরুদ্ধে আমরা অনেক অভিযোগ পাই। রাজউককে দ্রুত ডিজিটালাইজড করা দরকার। রাজউক চাইলে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব।’

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ বলেন, ‘নগর একটি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। কিন্তু নগরায়ণ পরিকল্পিত না হলে তাতে নাগরিক জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। বাংলাদেশে নগরায়ণের যে চিত্র তার সিংহভাগই ঢাকাকেন্দ্রিক। রাজধানী শহর হওয়ায় ঢাকার জনসংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকার জনসংখ্যা হবে ২৬ মিলিয়ন। তখন ঢাকা হবে পৃথিবীর ষষ্ঠ মেগা সিটি। দেশের অন্যান্য শহরের সুযোগ-সুবিধার তুলনায় ঢাকার সুবিধা বেশি হওয়ায় মানুষ গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হবে এটাই বাস্তবতা। তবে ঢাকা শহরের মানুষের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ড্যাপ বাস্তবায়নে যাতে কাজ করতে পারি সেটাই আমার প্রত্যাশা।’

এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘উন্নত শহর গড়ার সব উপাদান নিয়ে ড্যাপ করা হয়েছে। তাই সবাই মিলে কাজ করলে ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব। এফবিসিসিআই সব অংশীজনকে নিয়ে ড্যাপ বাস্তবায়নে করণীয় নির্ধারণ করবে। বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়নে সরকারকে এগোতে হবে। এবারের ড্যাপ যেন বাস্তবায়নযোগ্য হয়, এফবিসিসিআই সে উদ্যোগ নেবে।’

বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন-বিএলডিএ সভাপতি ও দেশের শীর্ষ শিল্পোদ্যোক্তা পরিবার বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবারের ড্যাপ তৈরি করতে গিয়ে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। আমি যত দূর শুনেছি এবার সব খাতের মতামত নেওয়া হয়েছে। অথচ ২০১০ সালের ড্যাপ দেখে মনে হয়েছিল বেসরকারি খাতকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। তখন যিনি রাজউকের মন্ত্রী ছিলেন, পূর্তমন্ত্রী ছিলেন তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল- বেসরকারি খাত বলতে কোনো জিনিস থাকবে না। সবকিছু করবে সরকার। তখন সঙ্গে সঙ্গে রিহ্যাবের তৎকালীন সভাপতিসহ আমরা প্রতিবাদ করলাম। আমি প্রতিবাদ করলাম। আমার সঙ্গে বাদ-প্রতিবাদ অনেক কিছু হলো। এ নিয়ে অনেক তর্কাতর্কি হলো। তখনকার এক প্রখ্যাত প্রকৌশলী বাংলাদেশের গর্ব ছিলেন, তিনি নিজেও স্বীকার করলেন ওই ড্যাপে ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। ড্যাপে অনেক ভুলত্রুটি হয়েছে। সে ভুলত্রুটি নিয়েই ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে। গেজেট করতে হবে এবং সেটাই সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল একটাই- সেখানে শুধু রাজউক, সরকারি খাতই ল্যান্ড ডেভেলপমেন্টস বা আবাসন যা-ই বলেন, সবই করবে রাজউক ও সরকার। তখন রিহ্যাবের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সেখানে সবাই বললেন, যে ড্যাপ হচ্ছে তা তো দেশকে ধ্বংস করে দেবে। তখন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। প্রধানমন্ত্রী বললেন, “আমি ড্যাপ রিভিউ কমিটি করে দিয়েছি”। তখন তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী রিভিউ কমিটি গঠন করেছিলেন সাতজন মন্ত্রী, ২১ জন সচিবকে নিয়ে। সেই রিভিউ কমিটি ড্যাপ পর্যালোচনা করে, নতুন করে অনুমোদন দেওয়ার কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ় মনোবল না থাকলে আজকে আবাসন খাতের ঢাকার ২ হাজারসহ সারা দেশের ২০ হাজার ডেভেলপার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। প্রধানমন্ত্রী শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বড় প্ল্যানার। তিনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দূরে দেখেন। আমরা যেটি আজ ভাবী, তিনি তা আগামীকালের জন্য চিন্তা করেন। ২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী যদি এই দূরদর্শী ভূমিকা না নিতেন, আজকে হয়তো বাংলাদেশ এই পর্যায়ে আসত না।’

বসুন্ধরা চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘আপনারা নিশ্চিই জানেন জিডিপিতে আবাসন খাতের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ অবদান আছে। এ খাতের ৪৭১টি খাতে ২০ হাজার শিল্পপ্রতিষ্ঠান জড়িত। অন্ততপক্ষে ১ কোটি লোক আবাসন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আজকে সত্যি কথাটা বলতে হয়- অনেকে হয়তো জানেন না। বলা যায়, সেদিন ড্যাপ ফাইনাল হয়েছিল একটি পত্রিকা অফিসে। সেদিন যদি আমরা ড্যাপ গ্রহণ করতাম, সেদিন থেকেই দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ওত পেতে ছিল। সেদিন আমরা বাধা না দিলে আজকে দেশের অন্য রূপ হতো। সেদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পরিবেশ দরকার। আবাসন খাতের উদ্যোক্তারা সবাই শিক্ষিত। এখানে এমন কোনো লোক নেই যারা পরিবেশ ধ্বংস করে দেশের উন্নয়ন করবেন। পরিবেশ না থাকলে আমরা কেউ বাঁচব না। আজকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের প্রধানমন্ত্রী কয়লাচালিত প্রকল্প বন্ধ করে দিয়েছেন। পরিবেশ নিয়ে আমরা সবাই সচেতন। পরিবেশ না বাঁচলে আমরা কেউ বাঁচব না। আজকে আমেরিকা সবচেয়ে বেশি পরিবেশবাদী। সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণকারীও তারা। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা পরিবেশ ঠিক রাখব। এ ব্যাপারে সবাইকে আরও বেশি আন্তরিক হতে হবে এবং পরিবেশ ঠিক রেখেই উন্নয়ন করতে হবে।’ এই করোনায় আমাদের ১০ শতাংশ মানুষকে বেকার হতে হয়েছে উল্লেখ করে বিএলডিএ সভাপতি আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘আজকে মন্ত্রীকে ধন্যবাদ এজন্য যে ড্যাপকে একটি সেমিনার পর্যায়ে আনতে পারছেন। ড্যাপ নিয়ে যেসব অংশীজন কথা বলতে চেয়েছেন তিনি তাদের কাউকে মানা করেননি। সুতরাং আমি মনে করি যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপের গেজেট করা উচিত। রিহ্যাবের যারা ডেভেলপার তারা হাজার হাজার চুক্তি করে রেখেছেন। কিন্তু তারা কোথাও ডেভেলপমেন্ট করতে পারছেন না। ঢাকায় ৫০ হাজার প্ল্যান পাস হচ্ছে না ড্যাপের কারণে। এ ড্যাপ নিশ্চয়ই এমন কোনো জিনিস না যে এটা পরিবর্তন হবে না। নিশ্চয়ই ড্যাপের রিভিউ কমিটি থাকবে। যাদের যেখানে অসুবিধা হবে, সমন্বয় হবে। কিন্তু আমার মনে হয় এটাই সময়। এখনই গেজেট না হলে আর কোনো দিনই সম্ভব হবে না।’

বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেন, ‘সবাই নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে সবাই পরিবেশসম্মত ভবন করবেন। পাশে খেলার মাঠ থাকবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। ঢাকা শহরের ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র একটি বাদে ৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। আমি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুরোধ করব- একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি খেলার মাঠ থাকতে হবে। এটা না হলে মানুষের বিকাশ হবে কীভাবে। এসব ব্যাপারে রাজউক আরও আন্তরিক হবে আশা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবারের ড্যাপ রাজউকের প্রকল্প পরিচালক অনেক সুন্দরভাবে করেছেন। মানুষের ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িতে গেছেন। প্রত্যেকের কাছ থেকে তথ্য ও পরিসংখ্যান নিয়েছেন। কিন্তু এটা সত্যি যে বাস্তবায়ন করা এত সহজ হবে না, যদি আমরা সবাই মিলে রাজউক ও পূর্ত মন্ত্রণালয়কে সাহায্য না করি। ঢাকা শহরে দুটি সুন্দর রাস্তার একটি মাদানি এভিনিউ, আরেকটি ৩০০ ফিট। কিন্তু কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই। এ দুটি রাস্তা ঢাকা শহরের গর্ব করার মতো বলা যায়। অথচ কোনো রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় রাতের বেলায় সব ট্রাক-বাসের গ্যারেজ হয়ে গেছে। এসব ব্যাপারেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। আগের ড্যাপের গেজেটে যেসব হাউজিং প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল সেসব যেন ঠিক থাকে। আমার দুঃখ লাগে যে, প্রেসিডেন্ট গেজেট করে দিয়েছেন, তার ওপরে দেখি রাজউকের বেশ কিছু অফিসার হাত বুলায়। প্রেসিডেন্ট যেখানে সই করেছেন সেখানে রাজউকের একটা ক্লার্ক বলেন, এই গেজেট মানি না! তাহলে কোথায় আমরা আছি।’

রাজউকের আধুনিকায়নে জোর দিয়ে আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘রাজউককে অবশ্যই ডিজিটালাইজড করতে হবে। প্ল্যানের ব্যাপারে সময় নির্ধারণ করতে হবে। মানুষের ভোগান্তিও কমাতে হবে। রাজউকের ভোগান্তির ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। রাজউককে গতিশীল করতে হবে। যারা ডেভেলপার আছেন তারা সহজভাবে যেন প্ল্যান পান, সে বিষয়টি রাজউক ও পূর্ত মন্ত্রণালয়কে নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘রাজউকে একজন চেয়ারম্যান এসে কাজ শুরু করেন। কদিন পর তিনি সচিব হয়ে চলে যান। এখানে এমন একজনের চেয়ারম্যান হওয়া উচিত যিনি কমপক্ষে তিন থেকে পাঁচ বছর কাজ করতে পারবেন। এভাবে দুই-তিনি-চার মাস পর চলে গেলে রাজউকের প্রতি কারও দায়বদ্ধতা থাকে না। রাজউকে ঢোকার পর ছয় মাস লাগবে কাজ বুঝতে। কিন্তু বোঝার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারম্যান সচিব হয়ে চলে গেলে তারা কাজ করার সময় পান না। ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে কমপক্ষে তিন থেকে চার বছরের জন্য একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দিন।’

বিএলডিএ সভাপতি আরও বলেন, ‘করোনায় ১০ লাখ লোক কাজ হারিয়েছেন। এখন একমাত্র আবাসন খাতেই তাদের অনেকের কর্মসংস্থান সম্ভব। দেশ, জাতি ও বিনিয়োগের জন্য ড্যাপ জরুরি। সময় ক্ষেপণ না করে যত শিগগির সম্ভব ড্যাপের প্রস্তাব আকারে অনুমোদন দিন। আমার মনে হয় এটা রিভিউ করা সম্ভব। রিভিউ কমিটি নিশ্চই শেষ হয়ে যাবে না।’

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-রিহ্যাব সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল বলেন, ‘ড্যাপের সঙ্গে বাংলাদেশের যার এক ইঞ্চি জমি আছে তারও ভাগ্য জড়িত। ড্যাপের ২ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্টস পড়ে বুঝতে সময় লাগবে। কারণ এবারের ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হলে ঢাকা থেকে ৫০ লাখ লোক বের করে দিতে হবে। ইতিমধ্যে ড্যাপের বাস্তবায়ন পিছিয়ে গেছে। ২০৩৫ সাল নাকি ৪০ সালে ড্যাপের বাস্তবায়ন হবে, আমি তা নিয়ে সন্দিহান। ৫৩ সংস্থার সম্মিলিত সমন্বয় ছাড়া ড্যাপ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এর আগে ড্যাপ দিয়ে বেসরকারি খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এখন ড্যাপ জনগণকে কী বার্তা দেবে তা-ও সরকারকে ভাবতে হবে।’

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বহুল প্রতীক্ষিত ড্যাপ অবশেষে বাস্তবায়ন হচ্ছে। আমরা চাই ড্যাপ দ্রুত বাস্তবায়ন হোক। এখন বাস্তবায়নটা কে করবে? রাজউক মূল বাস্তবায়নকারী হবে না সিটি করপোরেশন বাস্তবায়ন করবে তা নিয়ে আমাদের একমত হতে হবে। ঢাকা শহরে ২ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। গত চার বছরে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেশন করেছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের জন্য মানুষ ঢাকায় আসে। আমি মনে করি ড্যাপ বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশন একটা ভাইটাল রোল প্লে করবে। রাস্তা বানাবে সিটি করপোরেশন, ফুটপাথ বানাবে সিটি করপোরেশন, জলাবদ্ধতা নিরসন করবে সিটি করপোরেশন। পৃথিবীর সব দেশেই সিটি করপোরেশন এসব কাজ করছে। সিটি করপোরেশন মানেই শুধু ময়লা ও ড্রেন পরিষ্কার করবে তা নয়।’

পূর্ত সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার বলেন, ‘ড্যাপে ছোট-বড় সব বিষয়ে যত ধরনের সমস্যা রয়েছে তা বিবেচনা করা হয়েছে। এতে সব ধরনের প্রক্রিয়াও অনুসরণ করা হয়েছে। আজকের সেমিনারে পাওয়া মতামতও বিবেচনা করা হবে।’

নারায়ণগঞ্জ সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ‘কদিন আগে প্রস্তাবিত ড্যাপের কপি পেয়েছি। তবে এতটুকু বুঝেছি এতে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। ড্যাপ কাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে? তাদের সেই সক্ষমতা আছে কি না তা-ও বিবেচনায় নিতে হবে। রাজউক রেগুলেটরি নাকি ইমপ্লিমেন্টারি বডি হিসেবে কাজ করবে তা ঠিক করতে হবে।’

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ড্যাপ বাস্তবায়নে বেশি সময় নেওয়া ঠিক হবে না। ইতিমধ্যে পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিছু শর্ত সাপেক্ষে এটি অনুমোদন দেওয়া সম্ভব। এর আগে ঢাকার স্ট্রাকচার প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, ‘ড্যাপ বাস্তবায়ন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে থাকা উচিত। রাজউক তাদের সহায়তা দেবে।’

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘মাত্র চার দিন আগে ৪ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট দিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নতুন প্রস্তাবে আমাদের আগের দেওয়া সুপারিশ বা তথ্যগুলো খুঁজে পাইনি। রাজধানীতে কতগুলো “ছিটমহল” রয়েছে, যেখানে সরকারের কোনো দফতর বা সংস্থা প্রবেশ করতে পারে না, কাজ করতে পারে না। গণতান্ত্রিক সরকারের সময় নগর সরকারের কোনো বিকল্প দেখি না। সরকারের একাধিক সংস্থা ঢাকা শহর নিয়ে কাজ করে কিন্তু তাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এ-সংক্রান্ত আইনগুলো সংশোধন করা দরকার।’

স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে বসে মতামত নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো বাদ দিয়ে আজকে কেন ড্যাপ কী করে চূড়ান্ত করার কথা হচ্ছে তা নিয়ে আমার প্রশ্ন।’

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রচুর পরিকল্পনা হয় কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না। পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ২০৪১ সালের টার্গেট বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।’

রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই ২০১০ সালের ২২ জুন প্রথম ঢাকা মহানগর অঞ্চলের জন্য গেজেটের মাধ্যমে বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ডেটেইলড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ) প্রণয়ন করা হয়। যার মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। এরপর ওই বছরের মার্চে শুরু হয় ড্যাপ ২০১৬-২০৩৫ প্রণয়নের কাজ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর জেলার ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে একটি আধুনিক, দৃষ্টিনন্দন ও বাসযোগ্য মহানগরী গড়ে তুলতে প্রস্তাবিত ড্যাপ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে। আজকের জাতীয় সেমিনারে স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে এটি চূড়ান্ত রূপ পাবে।’ রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা বলেন, ‘২০১০ সালের ড্যাপে নানা ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল। ফলে সেটা সফল হয়নি। এবার স্টেকহোল্ডারদের মতামতের ভিত্তিতে যত দ্রুত সম্ভব ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।’

রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘রাজধানীর চারপাশে চারটি নদ-নদী ও বেশ কিছু খাল রয়েছে। এগুলো সংস্কার করে আমরা সুন্দর একটি ঢাকা গড়ে তুলতে পারি।’ ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ‘আমি ওয়াসার পানি ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছি ড্যাপের বাস্তবায়ন কতটা জরুরি। অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে তাল মেলাতে ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা হয়েছিল। তা সফলতার সঙ্গে সিটি করপোরেশনে হস্তান্তর করেছি।’ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, ‘তড়িঘড়ি ড্যাপ বাস্তবায়ন করা হলে অসংগতি থেকে যাবে। যে পদ্ধতিতে ড্যাপের ডাটা অ্যানালাইসিস করা হচ্ছে তা আপগ্রেড করা দরকার।’

জাতীয় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন ডিটিসিসির খন্দকার রাকিবুর রহমান, ডিপিডিসির গিয়াস উদ্দিন জোয়ার্দার, বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল প্রমুখ।

সর্বশেষ খবর