রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

হাফ ভাড়া নিয়ে বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়া শেষ, সড়কেই শিক্ষার্থীরা

ঢাকার অধিকাংশ বাস মালিক গরিব : এনায়েত

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাফ ভাড়া নিয়ে বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়া শেষ, সড়কেই শিক্ষার্থীরা

নিরাপদ সড়কের দাবিতে গতকালও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ -বাংলাদেশ প্রতিদিন

নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈমসহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সব শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, নিরাপদ সড়ক, বাসে অর্ধেক ভাড়া বা হাফ পাস চালুর দাবিতে তৃতীয় দিনের মতো রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মোড়ে অবস্থান নেন আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা।

এ ছাড়া পুরান ঢাকার সদরঘাটগামী সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন কবি নজরুল ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। এদিকে বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া ঠিক করা নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে। এ ছাড়া নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির মূল চালক হারুনের দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল ধানমন্ডি ২৭ নম্বর মোড়ে অবস্থান নেওয়া ছাত্রছাত্রীরা দাবির পক্ষে স্লোগান দেন। পাশাপাশি তারা ধানমন্ডির বিভিন্ন সিগন্যালে থাকা প্রাইভেট কার, বাস ও মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করেন। লাইসেন্সবিহীন গাড়িতে মার্কিং কলম দিয়ে বিভিন্ন লেখা বা চিহ্ন এঁকে দেন। এদিকে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থীরা লক্ষ্মীবাজার থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রায়সাহেব বাজার মোড়ে অবস্থান করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। তারা রায়সাহেব বাজার মোড় অবরোধ করে স্লোগান দেন। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিক্ষোভ চলাকালে শিক্ষার্থীরা পুলিশের গাড়ি, সদরঘাটগামী বাসগুলোর লাইসেন্স চেক করেন। অবরোধে অংশ নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হাফ ভাড়া দেওয়ায় এ রুটের বাসগুলো ছাত্রীদের বাসে তোলে না। ছাত্রী দেখলে দরজা বন্ধ করে রাখে। হাফ ভাড়া দিতে চাইলে বাস থেকে নামিয়ে দেয়। আমরা সুশৃঙ্খলভাবে বাসে চলাচল করতে চাই। এ দাবিতে সড়ক অবরোধ করেছি।’ আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘হাফ পাসের কারণে অনেক বাস আমাদের তুলতে চায় না। হাফ ভাড়া দিতে গেলে হয়রানিরও শিকার হতে হয়।’ শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমাদের জন্য হাফ পাস নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, মেয়ে শিক্ষার্থীদের লাঞ্ছিত করা, শিক্ষার্থী দেখলে বাসের দরজা বন্ধ করে দেওয়া- অতি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। শুধু বিআরটিসি বাসে হাফ পাস নির্ধারণ করা হয়েছে এতে আমাদের কোনো লাভ হয়নি। সদরঘাটে বিআরটিসির কোনো বাস আসে না।’ এ সময় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণ ও নাঈমসহ সড়কে শিক্ষার্থী মৃত্যুর দ্রুত বিচার দাবি করেন।

দুই দিনের রিমান্ডে হারুন: নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লাবাহী গাড়ির মূল চালক মো. হারুনকে আদালতের নির্দেশে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গতকাল পল্টন থানায় করা মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আনিছুর রহমান সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করে তাকে আদালতে হাজির করেন। শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলামের আদালত দুই দিন মঞ্জুর করে।

এর আগে শুক্রবার ভোরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে হারুনকে গ্রেফতার করা হয়। র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হারুন জানিয়েছেন, তিনি ময়লাবাহী এ গাড়িটি নিয়মিতভাবে চালিয়ে আসছেন। বুধবার তিনি অনুপস্থিত থাকায় তার সহকারী রাসেল গাড়িটি চালান। তবে হারুনের কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। বুধবার গ্রেফতার করা হয় দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে থাকা চালক মো. রাসেল খানকে। পরে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে আদালতে হাজির করলে বিচারক তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের ডিসি আবদুল আহাদ জানান, ময়লার গাড়িটি চালাচ্ছিলেন রাসেল। কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে ওই গাড়ির চালক নন। রাসেল জিজ্ঞাসাবাদে জানান, চালক হারুনের কাছ থেকে তিনি গাড়িটি নিয়েছেন। ডিএসসিসি-সূত্র জানান, ময়লাবাহী ওই গাড়ির প্রকৃত চালক ইরান মিয়া। তিনি পরিচ্ছন্নতা কর্মী হারুনকে চুক্তি ভিত্তিতে গাড়িটি চালাতে দেন। হারুন আবার রাসেলকে চালাতে দেন। এ তিনজনকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ : বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া ঠিক করা নি?য়ে অংশীজনদের স?ঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হ?য়ে?ছে। তবে পরিবহন নেতাদের পক্ষ থেকে টাস্কফোর্স গঠনসহ কয়েকটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৈঠক শেষে পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ এ তথ্য দিয়ে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিক সমাধানের চেষ্টা চলছে। ঢাকার অধিকাংশ বাসমালিক গরিব। হাফ ভাড়া নিলে মালিকদের যে ক্ষতি হবে তা সরকার কীভাবে পূরণ করবে সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। সবার সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের প্রস্তাব দিয়েছি। হাফ ভাড়ার দাবিতে বাস ভাঙচুর, শ্রমিকদের মারধর অব্যাহত রয়েছে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’ টাস্কফোর্স কবে গঠন করা হবে এমন প্রশ্নে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘এটা নতুন প্রস্তাব। টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত আসবে তা সেভাবে বাস্তবায়ন হবে। পরিবহন নেতাদের পক্ষ থেকে কনসেশন দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে। কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কত ছাত্র, কতজন বাস ব্যবহার করে তার একটা পরিসংখ্যান চেয়েছেন নেতারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সে তথ্য দেবে।’ এদিকে বাসে হাফ পাসের সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের সড়ক ছেড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান ও পরিবহন নেতারা। এর আগে বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে হাফ পাস চালুর বিষয়ে বিআরটিএ ও বাস মালিক সমিতির মধ্যে অনুষ্ঠিত সভা কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ওই বৈঠকে বাসমালিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়- যেহেতু সরকার বেসরকারি বাসে ভর্তুকি দেয় না সেহেতু ভাড়া কম নেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ যানজটের কারণে ট্রিপের সংখ্যা কমেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই হাফ ভাড়া নিলে লোকসান গুনতে হবে। প্রসঙ্গত, বুধবার বেলা ১১টায় রাজধানীর গুলিস্তান গোলচত্বরে হল মার্কেটের সামনে ডিএসসিসির ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যু হয়। তিনি কলেজের মানবিক শাখার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ওই ঘটনার পর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করে দায়ীদের বিচারের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা।

সুসম্পর্ক থেকে উত্তর সিটির ময়লার গাড়ি হাতে পান হানিফ : সংবাদকর্মী আহসান কবীর খানকে চাপা দেওয়া ময়লার গাড়ির চালক হানিফ ওরফে ফটিক কাগজে-কলমে করপোরেশনের কেউ নন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কর্মরতদের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে গাড়ি পেয়েছিলেন। গাড়ির তেল বিক্রি করা টাকা মজুরি হিসেবে পকেটে ভরতেন। কাউকে ভাগ দিতেন কি না এখনো জানা যায়নি। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব জানান আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।

সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, বৃহস্পতিবার পান্থপথে সংবাদকর্মী আহসান কবীর খানকে চাপা দেওয়া গাড়িটি হানিফ (২৩) চালাচ্ছিলেন। তার সঙ্গে সহকারী হিসেবে ছিল ১০ বছরের এক শিশু। পান্থপথ হয়ে গাবতলীতে ময়লা ফেলার কথা ছিল তাদের। প্রতিদিনের মতো ওই দিনও তিন থেকে চারবার এ পথে যাওয়ার কথা ছিল গাড়িটির। তৃতীয়বার ময়লা নিয়ে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনা ঘটে এবং তারা ভয়ে পালিয়ে যান। হানিফ প্রথমে গাবতলী যান, সেখান থেকে চাঁদপুরে নানাবাড়িতে আত্মগোপন করেন। হানিফের হালকা গাড়ি চালানোর সনদ আছে। তিনি সিটি করপোরেশনের গাড়ি সারাইখানায় সহকারী হিসেবে প্রায় আট বছর কাজ করেছেন। পরে সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন পদে কর্মরতদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। তারাও সিটি করপোরেশনের গাড়ি হানিফের হাতে ছেড়ে দিতে শুরু করেন। ২০১৯ সালে তিনি হালকা যান চালানোর সনদ পান।

প্রথমে ছোট ট্রাক চালাতেন, এরপর ময়লার ট্রাক হাতে পান। তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব জানতে পেরেছে ময়লার গাড়ি চালানোর বিনিময়ে হানিফ কোনো টাকা পেতেন না। প্রতিদিন গাড়ির জন্য যে তেল বরাদ্দ থাকত সেখান থেকে বেঁচে যাওয়া তেল বিক্রি করতেন হানিফ। এটাই ছিল অলিখিতভাবে তার মজুরি। বৃহস্পতিবার রাজধানীর পান্থপথে ময়লার গাড়ির চাপায় মারা যান সংবাদকর্মী আহসান কবীর খান। তিনি একজনের সঙ্গে রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেলে ছিলেন। পেছন থেকে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় তিনি রাস্তায় ছিটকে পড়েন। এরপর গাড়িটি তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। এ ঘটনায় অজ্ঞাত চালককে আসামি করে তার স্ত্রী নাদিরা পারভীন কলাবাগান থানায় মামলা করেন।

সর্বশেষ খবর