বৃহস্পতিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

রাজধানীতে ছাত্রবিক্ষোভ অব্যাহত

তোপের মুখে পুলিশ, জরিমানা, এইচএসসি পরীক্ষার জন্য আজ সীমিত কর্মসূচি, সাভারে শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়ায় মহাসড়ক অবরোধ রামপুরার ঘটনায় ৮০০ আসামি

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীতে ছাত্রবিক্ষোভ অব্যাহত

রাজধানীর রামপুরা ব্রিজে গতকাল শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর রামপুরা ব্রিজে পুলিশের একটি গাড়িকে দাঁড় করায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা চালকের কাছে লাইসেন্স দেখতে চায়। এ ঘটনা গতকাল দুপুর ১টার। চালক কিছুই দেখাতে না পেরে উল্টো শিক্ষার্থীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন। এ সময় বিক্ষুব্ধরা ওই পুলিশকে উদ্দেশ করে ‘ভুয়া ভুয়া’ ‘মাফ চান, মাফ চান’ স্লোগান দিতে থাকে। পরে শিক্ষার্থীদের সান্ত¡না দিতে এগিয়ে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নুরুল আমীন। তিনি ওই চালক পুলিশ সদস্যের পক্ষে শিক্ষার্থীদের ‘সরি’ বলেন। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে জরিমানা করার আশ্বাস দেন। ওই চালককে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এদিকে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে আজ বৃহস্পতিবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। বেলা ১২টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সীমিত কর্মসূচি পালন করবে। এ সময় তারা সড়কের এক পাশে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করবে, যাতে যান চলাচলে বিঘ্ন না ঘটে।

টানা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গতকাল রাজধানীতে সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মিছিল, গাড়ির কাগজপত্র যাচাই ও ১১ দফা দাবি উত্থাপনসহ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে শিক্ষার্থীরা। মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে সড়ক বন্ধ করে দেয় শিক্ষার্থীরা। এতে ওই সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল দুপুর ১টায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ উচ্চ বিদ্যালয় এবং মতিঝিল সেন্ট্রালের শতাধিক শিক্ষার্থী শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় ছাত্ররা জানায়, দা?বি একটাই, নিরাপদ সড়ক চাই। ‘জেগেছে জেগেছে ছাত্র সমাজ জেগেছে’ ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ‘আমার ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’- এমন স্লোগান দিতে থাকে। এর আগে নিরাপদ সড়কের দাবিতে গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় রামপুরা ব্রিজে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। বেলা ১টায় তারা একটি মিছিল নিয়ে রামপুরা ব্রিজ থেকে রামপুরা বাজার পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে আসে। এরপর রামপুরা ব্রিজে ফিরে এসে তারা আজকের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি ঘোষণা করে গতকালকের বিক্ষোভ সমাপ্ত ঘোষণা করে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানায়, আজ (বৃহস্পতিবার) এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে তারা আজ দুপুর ১২টায় কর্মসূচি শুরু করবে। তারা সড়কের এক পাশে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করবে। কর্মসূচি চলাকালে যান চলাচলে যেন বিঘ্ন না ঘটে, সেটি তারা নিশ্চিত করবে। এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের যেন কোনো সমস্যা না হয়, আবার আন্দোলনও যেন চলমান থাকে, সেটি মাথায় রেখে তারা এগোবে। সরেজমিন দেখা গেছে, গতকাল রামপুরা ব্রিজে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের কাগজপত্র ঠিক আছে কি না, তা যাচাই করে দেখছে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি গাড়ির কাগজপত্র দেখাতে বলে তারা। কিন্তু গাড়িটির শুধু ইঞ্জিন নম্বর ছিল। চালকের লাইসেন্স ছিল না। চালকের সঙ্গে বাগ?বিতন্ডার একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত হন। ঘণ্টাখানেক পর পুলিশ জরিমানা করার পরে শিক্ষার্থীরা গাড়িটি ছেড়ে দেয়। এ বিষয়ে ডিএমপির খিলগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার (এসি-প্যাট্রল) রেজাউল হাসান জানান, ওই গাড়ির চালকের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। চালককে ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মতিঝিলেও রাস্তা বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা গাড়ি ও মোটরসাইকেলের চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখে। কারও লাইসেন্স না থাকলে গাড়ি আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দিয়ে দেয়। এতে মতিঝিলের চার দিকের সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এখানে বিক্ষোভ চলাকালে হিমালয় পরিবহনের একটা বাস ভাঙচুর করে শিক্ষার্থীরা। ছাত্রদের দাবি, লাইসেন্স চেক করার সময় হিমালয় পরিবহনের চালক প্রথমে কাগজপত্র না দেখিয়ে ধাক্কা দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গাড়ির গ্লাস ভাঙচুর করে তারা। তবে চালক মেহেদির দাবি, চাওয়া মাত্রই কাগজপত্র দেখিয়েছেন। কাউকে ধাক্কা দেননি বলেও জানান তিনি। পরে দুপুর ২টায় শিক্ষার্থীরা রাস্তা ছেড়ে দিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। রামপুরায় শিক্ষার্থীরা নতুন করে ১১টি দাবি জানিয়েছে। তাদের দাবিগুলো হলো- ১. সড়কে নির্মম কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনউদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। ২. সারা দেশে সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ৩. গণপরিবহনে ছাত্র-ছাত্রী এবং নারীদের অবাধ যাত্রা ও ভালো ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ৪. ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৫. সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬. বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সব পরিবহন মালিকের মধ্যে তাদের অংশ অনুযায়ী সমানভাবে বণ্টন করার নিয়ম চালু করতে হবে। ৭. শ্রমিকদের নিয়োগপত্র-পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তি ভিত্তিতে বাস চালানো বন্ধ করে টিকিট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. গাড়ি চালকের কর্মঘণ্টা একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে দুজন চালক ও দুজন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ৯. যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ১০. ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্যান্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। ১১. মাদকাসক্তি নিরসনে সমাজজুড়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সাভারে শিক্ষার্থীকে গাড়িচাপা দেওয়ায় মহাসড়ক অবরোধ :  সাভারে এক শিক্ষার্থীকে গাড়িচাপা দেওয়ায় প্রায় আধাঘণ্টা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় মহাসড়কে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাকিজা কারখানার সামনে ঢাকাগামী লেন অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সকালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ওই স্থানে রাস্তা পারাপারের সময় আতিক (১৪) নামের এক শিক্ষার্থীকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় একটি পিকআপ ভ্যান। ঘটনা জানাজানি হলে সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সাভার মডেল কলেজসহ তিন কলেজের শিক্ষার্থীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে। এ সময় চালকের লাইসেন্স না থাকায় শিক্ষার্থীরা ১০ থেকে ১২টি গাড়ি আটক করে।

পরে ট্রাফিক পুলিশ তাদের জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। গত ১৮ নভেম্বর বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ শুরু করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ২৪ নভেম্বর গাড়িচাপায় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর তা রূপ নেয় নিরাপদ সড়কের ৯ দফা দাবির আন্দোলনে। এর মধ্যে সোমবার রাতে রামপুরায় বাসের চাপায় নিহত হয় এসএসসির ফলপ্রত্যাশী মাইনুদ্দিন ইসলাম দুর্জয়। তার মৃত্যুর জেরে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৮০০ জনকে আসামি করে দুই থানায় দুটি মামলা করেছে পুলিশ। রামপুরা ও হাতিঝিল থানায় করা দুই মামলাতেই ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের জন্য উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র-জনতাকে দায়ী করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে রামপুরা থানার মামলাটি করেন এসআই মারুফ হোসেন। সেখানে অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম। একই ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে আরেক মামলা করেছেন ওই থানার এসআই একেএম নিয়াজ মোল্লা। এখানে অজ্ঞাত ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান থানার ওসি আবদুর রশিদ।  তবে মাইনুদ্দিনের মৃত্যুর ঘটনায় তার মা রাশেদা বেগম বাদী হয়ে মঙ্গলবার গ্রিন অনাবিল পরিবহনের সংশ্লিষ্ট বাসের চালককে আসামি করে রামপুরা থানায় একটি মামলা করেছেন। এ মামলায় বাসের চালক সোহেল (৩৫) এবং তার সহকারী চাঁন মিয়াকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

রামপুরার ঘটনায় ৮০০ আসামি : রামপুরায় শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর বাসে আগুন ও ভাঙচুরের দুই মামলায় ৮০০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

অবৈধ বাসের বিরুদ্ধে অভিযান : রুট পারমিটবিহীন বাস ও পারমিটবিহীন রুটে চলাচল করা বাসের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলিস্তানে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। গতকাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এ অভিযান চালায়। অভিযান পরিচালনা করেন ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবদুস সামাদ। এ সময় প্রতিটি বাসে উঠে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করা হয়। এ ছাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া চার্ট অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে কি না এ বিষয়েও জানতে চাওয়া হচ্ছে। অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়তেই গুলিস্তানের আশপাশের বিভিন্ন সড়কে বাসের সংখ্যা কমে যেতে দেখা যায়। বিআরটিএ’র পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) মো. সরওয়ার আলম জানিয়েছেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে গতকাল ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে ১২টি স্পটে ১১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ২৩টি বাসকে ১ লাখ ৪৯ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া একই অপরাধ পুনাবৃত্তির কারণে ৯টি বাসকে ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর