রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

শিক্ষকের মৃত্যুতে কুয়েট ছাত্রলীগ সম্পাদকসহ বহিষ্কার ৯

নিজস্ব প্রতিবেদক, খুলনা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ নয় শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ  ও তথ্য শাখা থেকে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য জানানো হয়।

এদিকে নয় শিক্ষার্থীর সাময়িক বহিষ্কারাদেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছে শিক্ষক সমিতি। তবে স্থায়ী বহিষ্কারসহ অন্যান্য দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত একাডেমিক কার্যক্রম বর্জনের সিদ্ধান্তে শিক্ষকরা অনড় রয়েছেন। অপরদিকে চাপপ্রয়োগ করে সাময়িক বহিষ্কারাদেশকে ‘ব্যক্তিগত এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন বলে দাবি করছে কুয়েট ছাত্রলীগ। শিক্ষক সমিতি, কর্মচারী ও ছাত্রলীগের একটি অংশ নেপথ্যে কাজ করছে বলে ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান (সিএসই রোল ১৩০৭০২৪) মন্তব্য করেছেন। বহিষ্কৃত অন্য শিক্ষার্থীরা হলেন- তাহামিদুল হক ইশরাক (সিই রোল-১৫০১০৯০), সাদমান সাকিব (এলই রোল-১৫১৯০৩৩), রাগিব আহসান মুন্না (এলই রোল-১৫১৯০৪৮), মাহমুদুল হাসান (সিই রোল-১৬০১০২৯), মোহাম্মাদ কামরুজ্জামান (এমই রোল-১৬০৫০৩৯), মো. রিয়াজ খান নিলয় (সিএসই রোল-১৬০৭০৭৫), ফয়সাল আহমেদ রিফাত (এমই রোল-১৬০৫০৯৩), মো. নাইমুর রহমান অন্তু (এমএসই রোল-১৬২৭০১০)। এর মধ্যে সাদমান সাকিব ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার কৃষি শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, রাগিব আহসান মুন্না সাংগঠনিক সম্পাদক, কামরুজ্জামান সাংগঠনিক সম্পাদক, ফয়সাল আহমেদ রিফাত সদস্য, নাইমুর রহমান অন্তু উপশিক্ষা ও পাঠাগার সম্পাদক। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ ও তথ্য শাখা থেকে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার বিষয়টি গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের ৭৬তম সভায় উত্থাপন করা হলে সিসিটিভির ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্যাদি পর্যালোচনা করে বিষয়টির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশৃঙ্খলা ও আচরণ বিধির আলোকে অসদাচরণ-এর আওতায় সিন্ডিকেট এসব শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ জানা যায়, গত ৩০ নভেম্বর দুপুর ৩টার দিকে কুয়েটের ইইই বিভাগের শিক্ষক ও লালন শাহ হলের প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেন হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে সেলিম হোসেন কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মীর মানসিক নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। হলের ‘ডাইনিং ম্যানেজার’ নির্বাচন নিয়ে ড. সেলিম হোসেনকে বেশ কিছুদিন ধরে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। ওই দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে গতিরোধ করে ওই শিক্ষককে তড়িৎ প্রকৌশল ভবনে তার ব্যক্তিগত কক্ষে এনে আধাঘণ্টা রুদ্ধদার বৈঠক করে। এরপর ড. সেলিম দুপুরের খাবারের জন্য বাসায় গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

পরে এই মৃত্যুকে অস্বাভাবিক দাবি করে ঘটনায় জড়িত দোষী ছাত্রদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে একাডেমিক কার্যক্রম বয়কট করে শিক্ষক সমিতি। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় গত শুক্রবার ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রতীক চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘১ নম্বর দাবি সাময়িক বহিষ্কার বাস্তবায়ন হয়েছে, এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। কিন্তু মূল দাবি- তদন্তে প্রকৃত দোষীদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা না পর্যন্ত শিক্ষকরা একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন। এ ছাড়া ড. মো. সেলিম হোসেন স্যারের পরিবারকে সাহায্যসহ আরও কিছু দাবি আছে, যে ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো দিকনির্দেশনা না দেওয়ায় শিক্ষক সমিতি আগের কর্মসূচিতেই অনড় থাকছে।’ এদিকে সাময়িক বহিষ্কারাদেশের সিদ্ধান্তকে ‘ব্যক্তিগত এজেন্ডা’ বাস্তবায়ন বলে দাবি করছে ছাত্রলীগ কুয়েট শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান। তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তিতে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে- এটা কোন মেডিকেল রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, কোন তথ্য বা প্রমাণের ভিত্তিতে বা কোন তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেল তা স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষক সমিতির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, তাদের বেশ কিছু স্বার্থ আছে, সামনে তাদের নির্বাচন আছে। কর্মকর্তাদের একটা অংশও বিরোধিতা করছে, তাদেরও সামনে নির্বাচন আছে। এ ছাড়া ছাত্রলীগের আরেকটা অংশ যারা নতুন কমিটিতে পদ-পদবি প্রত্যাশী। তারাই ছাত্রদের আন্দোলনে পিছনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ঘটনার যে ভিডিও ফুটেজ দেখানো হচ্ছে তারাই তা প্রথমে সংগ্রহ করেছে ও মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। জানা যায়, প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের শনাক্তকরণসহ সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ রিপোর্ট প্রদানের জন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে নতুন করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সভাপতি প্রফেসর ড. মহিউদ্দিন আহমাদ, সদস্য প্রফেসর ড. খন্দকার মাহবুব হাসান, সদস্য সচিব প্রফেসর ড. মো. আলহাজ উদ্দীন, বহি. সদস্য পুলিশ কমিশনার, কেএমপি, খুলনা-এর মনোনীত একজন প্রতিনিধি (ন্যূনতম সহকারী কমিশনার পদমর্যাদা সম্পন্ন) এবং বহি. সদস্য জেলা প্রশাসক, খুলনা-এর মনোনীত একজন প্রতিনিধি (ন্যূনতম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদা সম্পন্ন)। কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত করে সুপারিশসহ রিপোর্ট ভাইস চ্যান্সেলর বরাবর দাখিল করতে অনুরোধ করা হয়েছে। এদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি কুয়েটের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ বিভাগের শিক্ষকের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িতদের এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ফৌজদারি আইনের আওতায় আনতে হবে। গতকাল স্থানীয় উমেশ চন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে মওলানা ভাসানীর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।

সর্বশেষ খবর