রক্তক্ষয়ী ফেনী বিলোনিয়া সম্মুখ যুদ্ধ ছিল সামরিক রণকৌশল ও নৈপুণ্যের দিক থেকে উভয় পক্ষের জন্য একটি উত্তপ্ত রণাঙ্গন তথা জয়-পরাজয়ের এক বড় চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর বহু সামরিক কলেজ ও স্কুলে এই যুদ্ধের রণকৌশল পড়ানো হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণে পৃথিবীর বিভিন্ন সামরিক কলেজ থেকে জেনারেল এবং পদস্থ সেনাকর্মকর্তাদের একটি বড় প্রতিনিধি দল ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধের রণকৌশল সম্পর্কে জানতে রণক্ষেত্রসমূহ পরিদর্শন করেন। ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধের সফলতা ছিল সারা দেশের সমগ্র স্বাধীনতা যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তাই সেদিন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এই তাৎপর্যপূর্ণ বিলোনিয়া যুদ্ধের ওপর।
ফেনীর বুক চিরে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ও সড়কপথ প্রসারিত এবং চট্টগ্রামের দিক থেকে ফেনীই হলো সারা দেশের প্রবেশদ্বার (Feni is the gateway to Bangladesh from Chittagong side)। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভ থেকে পাক-বাহিনী ‘সোয়াত’ জাহাজে বাড়তি সৈন্য ও গোলাবারুদ নিয়ে আসছিল এবং চট্টগ্রাম বন্দরে সেগুলো খালাস হচ্ছিল এবং আরও বাড়তি সৈন্য ও গোলাবারুদসহ আরও জাহাজ ছিল নোঙর এবং খালাসের অপেক্ষায়। তাদের এই বাড়তি সৈন্য এবং গোলাবারুদ রেল এবং সড়ক দিয়ে ফেনীর ওপর দিয়ে সারা দেশে পাচার করে তাদের ঘাঁটি এবং অবস্থানগুলো আরও শক্তিশালী করা এবং যুদ্ধের গতিবেগ তাদের অনুকূলে নিয়ে আসার এক বড় ধরনের পরিকল্পনা ছিল তাদের। মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর নোয়াখালীর (ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম ও লাকসামের অংশ বিশেষ) রাজনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক এবং নিউক্লিয়াস দশম ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠাতা-অধিনায়ক হিসেবে আমার ওপর দায়িত্ব ছিল ‘ফেনীর ওপর দিয়ে যেন একটি পিপীলিকাও যেতে না পারে।’ তারা এই বাড়তি সৈন্য ও গোলাবারুদ ফেনী হয়ে সারা দেশে নিতে পারলে যুদ্ধের গতিবেগ তাদের অনুকূলে হতো তীব্র থেকে তীব্রতর। তাই আমরা চট্টগ্রাম-ঢাকা রেল ও সড়কপথে ফেনী থেকে লাকসামের মধ্যবর্তী অংশে শরশর্দী, গুণবতী রেল সেতু এবং ফেনী- চৌদ্দগ্রাম মহাসড়কে বাজংকরা সড়ক সেতুসহ বেশ কিছু সেতু এবং কালভার্ট এবং ফেনী-বিলোনিয়া পথে আরও কিছু রেল- সেতু উচ্চক্ষমতাশালী বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে সমগ্র যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দেই। ফেনীর অদূরে কালীরবাজারে পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি থেকে আমরা মাত্র ১ হাজার গজের মধ্যে মুন্সীরহাটে তিন মাইল দীর্ঘ প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলি। নিউক্লিয়াস-দশম ইস্ট বেঙ্গল ও রাজনগর সাব-সেক্টরের মুন্সীরহাট ডিফেন্স এবং কালীরবাজারে শত্রুর প্রতিরক্ষার মাঝে আমরা প্রায় ৬০০-৭০০ গজ ঘন অ্যান্টি-ট্যাংক ও অ্যান্টি-পারসোনাল মাইনক্ষেত্র স্থাপন করি। শত্রু বাহিনীর ছিল ট্যাংক, কামান, হেলিকপ্টার, ছত্রী সেনা, জঙ্গি বিমান, মুহুরী নদীতে ছিল নেভাল গানবোট এবং ফেনীতে ছিল তাদের এক ব্রিগেডের অধিক সৈন্য। তাদের এই ক্ষমতার বিপক্ষে আমাদের ছিল অসীম মনোবল এবং শত্রু নিধন করে দেশ স্বাধীন করার দৃঢ় সংকল্প ও শপথ। এই সম্মুখযুদ্ধে শত্রু বাহিনী মে মাস থেকে ২১ জুন পর্যন্ত আমাদের ওপর অনেক আক্রমণ চালায় এবং একটি ব্রিগেড-আক্রমণসহ আমরা তাদের সব কটি আক্রমণ সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করি। জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি তার বই THE BETRAYAL OF EAST PAKISTAN (Page-207-209) এ স্বীকার করে বলেছেন, “A Brigade attack was launched which was repulsed by 10 East Bengal Regiment and Muktibahini jointly.”
শত্রু পক্ষের এই আক্রমণগুলোতে তারা যখন ৩/৪ শ গজ এগিয়ে আসত সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেতে রাখা মাইনগুলো খইয়ের মতো ফুটতে থাকত। তুমুল ও রক্ষক্ষয়ী ‘কুরুক্ষেত্র’ সদৃশ এই সম্মুখযুদ্ধে শত্রুপক্ষের প্রায় ৩০০ সৈন্য হতাহত হয়। অপরদিকে আমাদের হাবিলদার নুরুল ইসলাম বীরবিক্রম ও নায়েক লোকমানসহ জাস্মুরা ডিফেন্সের সহযোদ্ধা ও প্রায় ২৫ জন হতাহত হন। এ ছাড়া আমাদের ‘পাইনিয়ার প্লাটুন’ এর অনেক সহযোদ্ধা যুদ্ধাহত হন। প্রায় দেড় মাস স্থায়ী এই যুদ্ধে প্রত্যেক দিন দিবারাত্র উভয় পক্ষের মধ্যে অবিরাম কামানের গোলা বর্ষণ চলত। আমরা এতে এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে, আমাদের কাছে মনে হতো এটি যুদ্ধ-সংগীত। শত্রুপক্ষের অবিরাম গোলাবর্ষণে আমাদের ডিফেন্সের আশপাশের গ্রামগুলোর ঘরবাড়ি, স্কুল, গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে এবং বহু গ্রামবাসী হতাহত হয়। এই যুদ্ধ চলাকালীন এবং আমরা ব্রিগেড-অ্যাটাকসহ তাদের সব হামলা প্রতিহত করার একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে পাকিস্তান আর্মির সিজিএস জেনারেল হামিদ ফেনী সার্কিট হাউস থেকে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। সিজিএস জেনারেল হামিদের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণ, পাকিস্তানে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি বলছেন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) কোনো মুক্ত এলাকা নেই। আমরা সম্প্রতি ফেনী-বিলোনিয়া ঘুরে দেখেছি, ফেনী-বিলোনিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত। সেখানে পাকিস্তান-প্রশিক্ষিত এক ঝাঁক অফিসার, সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে এই মুক্ত অঞ্চল থেকে আপনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে যাতে চট্টগ্রাম থেকে কোনো বাড়তি সৈনিক ও গোলাবারুদ ফেনীর ওপর দিয়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে না যেতে পারে। আমরা এও শুনে এসেছি মুক্তিবাহিনী যদি এ ১৭ মাইল ভূখণ্ড যার মধ্যে রয়েছে তিনটি থানা এবং তিন দিক থেকে ভারতীয় সীমান্ত বেষ্টিত, এটি যদি তারা ধরে রাখতে পারে তাহরে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী দফতর এখানে গড়ে উঠতে পারে। এ কথা শুনে ইয়াহিয়া খান বিব্রত বোধ করেন এবং জেনারেল হামিদকে শ্রীলঙ্কা হয়ে সরাসরি ফেনীতে পাঠান।এই সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি আমাদের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্য থেকে আমরা এতটুকু বিচ্যুত না হয়ে চট্টগ্রাম থেকে যাতে বাড়তি শত্রু-সৈন্য ফেনী-চৌদ্দগ্রাম-কুমিল্লা পথে বা ফেনী-চৌমুহনী-লাকসাম-কুমিল্লা পথে যেন সারা দেশে পৌঁছতে না পারে সেজন্য গোটা রেল ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে থাকি এবং তাদের সরবরাহ রুটগুলো রুদ্ধ করে দেই। এতে করে তাদের ‘রিইনফোর্সমেন্ট’ ক্ষমতা অবশ হয়ে পড়ে এবং আমরা যুদ্ধের গতিবেগ আমাদের অনুকূলে রাখতে পারি। এই কারণেই ফেনী বিলোনিয়া যুদ্ধ ছিল সমগ্র দেশের মুক্তিযুদ্ধের সফলতা অর্জনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ২১ জুন শত্রুপক্ষ পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আমাদের ওপর সর্বগ্রাসী আক্রমণ শুরু করে এবং সেই অসম যুদ্ধে অহেতুক রক্তগঙ্গার পথ পরিহার করে আমরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল আর ডি হীরাসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডারদের সঙ্গে ওই দিনের, ওই মুহূর্তে বিরাজমান পরিস্থিতি অয়্যারলেসে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করে Tactical Withdrawal for Redeployment-এর সিদ্ধান্ত নেই এবং এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব নির্ধারিত স্থানে অর্থাৎ মুহুরী নদীর দক্ষিণ তীরে ফুলগাজী ও ফেনীকে মুখ করে Redeployment করি এবং এক ব্যাটালিয়ন প্লাস সাবসেক্টর ফোর্সসহ চতুর্মুখী প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলি। সেখান থেকে আমরা শত্রুর ওপর চতুর্মুখী হামলা চালাতে থাকি। আমাদের এই উপর্যুপরি অব্যাহত হামলার মুখে শত্রুর মনোবল সম্পূর্ণ এবং শক্তি লক্ষণীয় মাত্রায় কমে আসে। আমাদের অব্যাহত হামলায় এই সময় তাদের ১৫০ সৈন্য হতাহত হয় এবং প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের দখলে আসে। এ সময় ১০ বেঙ্গল ও সাবসেক্টরের সৈন্যদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয়ের মাধ্যমে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় গ্রাম-পর্যায়ে প্রায় ৮ হাজার গেরিলা যোদ্ধা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নেতৃত্বে সমগ্র এলাকায় শত্রুর ওপর আঘাত হানা অব্যাহত রাখে।
জুলাই থেকে অক্টোবর এই তিন মাসের রক্তক্ষয়ী ফুলগাজী যুদ্ধে ফেনী-ফুলগাজী-পরশুরাম পর্যন্ত আমরা শত্রু ঘাঁটিগুলোকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি এবং শত্রুবাহিনীকে নিজ নিজ অবস্থানে ‘কনফাইন’ করে প্রচণ্ড হামলা চালাতে থাকে, যেখানে তাদের ২০০-এর মতো সৈন্য হতাহতো হয়। সফল ফুলগাজী যুদ্ধের পর ৫ নভেম্বর থেকে পরশুরাম-চিথোলিয়া শত্রুর দুটি ঘাঁটির মধ্য দিয়ে ঢুকে তাদের বিধ্বস্ত করে ফেলি। এটিই ছিল ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধে সেই বিখ্যাত অভিযান- ‘অপারেশন ইনফিলট্রেশন।’
৫ নভেম্বর অন্ধকার শীতের রাত। টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পুরো রাতটা যেন কিছুর প্রতীক্ষায়। রাত ৯টায় অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করি। এমন একটা এলাকা ঘেরাওয়ের অভিযানে নেমেছি যেখানে তিন পাশেই ভারতীয় সীমান্ত। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে। পাশের লোকটিকেও দেখা যায় না। মুহুরী নদী ও সিলোনিয়া নদীর কোথাও বুক পানি, কোথাও পিচ্ছিল রাস্তার বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলছিল সবাই। নির্দেশ ছিল, সামান্যতম কোনো শব্দ যেন না হয়। এমনকি হাঁচি-কাশির শব্দও। বিদ্যুৎ চমকালে সবাই যেন মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে যায়। এমনকি নদী পার হতে পানির শব্দও যেন শোনা না যায়। কারণ একজন সৈনিকের একটি সামান্য ভুলে গোটা অভিযান বানচাল হয়ে যেতে পারে। অধিনায়ক হিসেবে সবাইকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত করে গন্তব্যে পৌঁছানো সত্যিই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। এই রক্তক্ষয়ী অপারেশনে শত্রু পক্ষের ২০০ সেনা হতাহত হয়। এই যুদ্ধে শত্রু বাহিনী আমাদের ওপর দুই দুই বার বিমান হামলা চালায়। এই হামলায় আমাদের বেশ কয়েকজন যোদ্ধা হতাহত হন। ১০ নভেম্বর দ্বিতীয় বিমান হামলায় চারটি যুদ্ধবিমান প্রচণ্ড শব্দে খুব নিচ দিয়ে উড়ে এসে আমাদের এলাকায় বোম্বিং শুরু করল। চারদিকে দাউদাউ করে ঘরবাড়ি জ্বলছে। আমরা অপেক্ষায় কখন বিমানগুলো আমাদের মেশিনগানের আওতায় আসবে। দেরি হলো না। মেশিনগান থেকে ছোড়া শুরু হয় তপ্ত বুলেট। তিনটি বিমান উড়ে গেল তাদের সীমানায়। চতুর্থ বিমান যখন ফিরে যাচ্ছিল দেখলাম ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। নিশ্চিত হলাম আমাদের মেশিনগানের গুলিতে এটি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। বিমানটি লাকসাম এলাকার অদূরে ভূপাতিত হয়। এই খবরটি জেনারেল হীরা অয়্যারলেসে আমাকে জানান। আমি খবরটি সবাইকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে গোটা রণাঙ্গন বিজয়ের উল্লাসে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। ১০ নভেম্বর রাতেই আমরা পরশুরাম ও বিলোনিয়া দখল করতে সক্ষম হলাম। সকালে দেখতে পেলাম। ধানখেতের পানি রক্তবর্ণ। চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে আছে শত্রু সৈন্যদের লাশ আর লাশ। অনেকে জখম। কারও হাত নেই। কারও পা নেই। যারা আহত হয়ে পালাতে চেয়েছিল তারাও পালাতে পারেনি। আহতদের চিকিৎসা দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাড়াতাড়ি চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম। একজন অফিসারসহ ৭২ জন সৈনিক দশম বেঙ্গল তথা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল। এটা ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা এবং ‘মিত্র বাহিনী’ গঠনের আগে পাকিস্তানি হানাদারদের মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রথম আত্মসমর্পণ।
১০ নভেম্বর পরশুরামের শত্রুর আত্মসমর্পণের পর আমরা ফেনী অভিযান শুরু করি। ৬ ডিসেম্বর ফেনী শত্রুমুক্ত হয়। ইতিমধ্যে আমরা ফেনী পর্যন্ত মাইন-ক্ষেত্রগুলো অপসারণ করতে করতে অগ্রসর হই। এর আগে ২১ নভেম্বর মুন্সীরহাটের অদূরে কালীর বাজারে আমার নেতৃত্বে ও ভারতীয় বাহিনীর ক্যাপ্টেন কিট কোলি ও তার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য সহকারে আমরা একযোগে গ্রেনেড নিক্ষেপ ও রেইডের মাধ্যমে শত্রুর একটি আর্টিলারি গান পজিশন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করি। ৩ ডিসেম্বর আমরা ফেনীর উপকণ্ঠে পৌঁছাই এবং ৩ থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত শত্রুর সঙ্গে আমাদের তিন দিন তুমুল যুদ্ধের পর শত্রু বাহিনী ৬ ডিসেম্বর ভোরের আগেই ফেনী থেকে পালিয়ে যায়। আমরা নোয়াখালী-সোনাইমুড়ী পর্যন্ত তাদের পিছু ধাওয়া করি। এ সময় তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে যায়। ৬ ডিসেম্বর ফেনী সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। ৭ ডিসেম্বর আমরা মুক্ত করি নোয়াখালী।
ফেনী-বিলোনিয়া যুদ্ধগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অভিযানে অশংগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন শহীদ, ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ, ক্যাপ্টেন মোখলেস, ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান, লে. কাইউম, ২/লে. দিদার, ২/লে. মীজান, ২/লে. সেলিম কামরুল হাসান, ক্যাপ্টেন মুজিবুর রহমান, ১০ বেঙ্গলের মেডিকেল অফিসার ডা. গফুর, ডা. হাসান ইমাম (যুদ্ধকালীন ভারতের মূর্তি থেকে এস এস-২ অফিসার্স কোর্স সমাপ্তকারী সম্মুখযোদ্ধা) ও ফ্লাইং ক্যাডেট অফিসার ওবায়দুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান (পরবর্তীতে মেজর), মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন, স্টাফ অফিসার গোলাম মুস্তাফা, সুবেদার মেজর (অপস্) নজরুল, সুবেদার মেজর মাইজুর রহমান (হেডকোয়ার্টার্স কোং) প্রমুখ।
৬ ডিসেম্বর মুক্ত স্বাধীন ফেনীতে আমরা বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করি। ফেনীর সড়ক ও জনপথে সর্বস্তরের আবালবৃদ্ধবনিতার ঢল নামে। ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ফেনীর আকাশ-বাতাস। সেদিন মা বাবারা তাদের শিশু সন্তানদের কাঁধে নিয়ে রাজপথ প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সবাই আমাদের এক নজর দেখার জন্য, একটু স্পর্শ করার জন্য প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে আমাদের কাছে এগিয়ে আসে। অনেকে ফুল নিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানায়। এক আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয় সমগ্র ফেনীতে। সেদিন আমি দেখেছি অনেকের চোখে বিজয়ের আনন্দ অশ্রু। কারও চোখে স্বজন হারানো বেদনার অশ্রু- সব যেন একাকার হয়ে গেছে। ফেনীবাসী সেদিন দলমত সব কিছু ভুলে মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন এই প্রত্যাশায় এখন তারা নিজের দেশকে নিজের হাতে গড়ে তুলতে পারবেন, যেখানে থাকবে না কোনো হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, ভেদাভেদ। মুক্তিযুদ্ধের সেদিনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং উজ্জীবিত হয়ে আমরা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে এগিয়ে নেব দেশকে, এই ছিল সেদিন সবার প্রত্যাশা। উল্লেখ্য, এই ৬ ডিসেম্বরই ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে।
অনুলিখন- শফিকুল ইসলাম সোহাগ