বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

নতুন নতুন এলাকা মুক্ত, দেশ চূড়ান্ত বিজয়ের পথে

নিজস্ব প্রতিবেদক

নতুন নতুন এলাকা মুক্ত, দেশ চূড়ান্ত বিজয়ের পথে

আজ ৮ ডিসেম্বর। কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, মাদারীপুরের কালকিনি ও হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ মুক্ত দিবস। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের এই দিনে এসব অঞ্চল হানাদারমুক্ত করেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। দেশের আকাশে উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। বিজয়ের আনন্দে সেদিন ফেটে পড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী সাধারণ মানুষ।

কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, মাদারীপুর ও হবিগঞ্জ থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য-

কুমিল্লা : ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় কুমিল্লা। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীসহ সর্বস্তরের জনগণের উল্লাস ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল জানান, ৭ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনীর ৬১ ব্রিগেডের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল মাহেন্দ্রপাল সিং, বাংলাদেশের মেজর আইন উদ্দিন, ক্যাপ্টেন আশরাফ, লে. হারুন ও মুক্তিযোদ্ধা রেজাউর রহমান বুলবুল, মো. শাহ আলম ও সফিউল আহমেদ বাবুলের নেতৃত্বে বিমানবন্দরের পাকিস্তানি সেনাঘাঁটিতে আক্রমণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক পাক সেনা নিহত হয়। বিমানবন্দরের ঘাঁটিতে কয়েকজন পাক সেনা আত্মসমর্পণ করে। কিছু সেনা বিমানবন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে বরুড়ার দিকে এবং সেনানিবাসে ফিরে যায়। পরদিন ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হয়। ভোরে মুক্তি সেনারা শহরের চকবাজার টমছম ব্রিজ ও গোমতী পাড়ের ভাটপাড়া দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করে শহরে প্রবেশ করেন। রাস্তায় জনতার ঢল নামে।

চাঁদপুর : ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীর বলয় থেকে মুক্ত হয়েছিল চাঁদপুর। চাঁদপুর মডেল থানার সম্মুখে বিএলএফ বাহিনী প্রধান মরহুম রবিউল আউয়াল কিরণ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধা ডা. সৈয়দা বদরুন নাহার চৌধুরী বলেন, ৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী চাঁদপুর আসতে শুরু করলে মুক্তিসেনাদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ভারতের মাউন্টেন ব্রিগেড ও ইস্টার্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ আক্রমণে দিশাহারা হয়ে পাকিস্তানের ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল রহিম খান আহত হয়ে লঞ্চযোগে চাঁদপুর থেকে পলায়ন করেন। ৩৬ ঘণ্টা লড়াইয়ের পর ৮ ডিসেম্বর জেলার হাজীগঞ্জ এবং চাঁদপুর শহর মুক্ত হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ১৯৭১ সালের এই দিনে সকাল ৯টার দিকে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল জোনের প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা দেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে শত্রুমুক্ত করতে ৩০ নভেম্বর থেকে আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে মিত্রবাহিনী। ১ ডিসেম্বর আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় ২০ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ৩ ডিসেম্বর আখাউড়ার আজমপুরে প্রচণ্ড যুদ্ধে ১১ পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৪ ডিসেম্বর পাক হানাদাররা পিছু হটতে থাকলে আখাউড়া অনেকটাই শত্রুমুক্ত হয়। এখানে রেলওয়ে স্টেশনের যুদ্ধে পাকবাহিনীর দুই শতাধিক সেনা হতাহত হয়। ৬ ডিসেম্বর আখাউড়া সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়। ওই দিন পাক সেনারা পালিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকারদের সহায়তায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের অধ্যাপক কে এম লুৎফুর রহমানসহ জেলা কারাগারে আটক অর্ধশত বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে শহরের করুলিয়া খালের পাড়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ৮ ডিসেম্বর কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত হয়।

পটুয়াখালী : ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদারমুক্ত হয় পটুয়াখালী জেলা। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় পটুয়াখালী শহরের কালিকাপুর এলাকায় অতর্কিত বিমান হামলা চালায় হানাদার বাহিনী। এতে শহীদ হন ১৯ জন নিরীহ মানুষ। শহরের পুরাতন বাজারে অগ্নিসংযোগসহ নির্বিচারে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় হানাদাররা। মুক্তিযোদ্ধারা চোরাগোপ্তা হামলা চালাতে থাকে। ১৮ নভেম্বর গলাচিপা উপজেলার পানপট্টিতে পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ হয়। ৭ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা হানাদারদের কোণঠাসা করে ফেলে। ওই রাতেই লঞ্চে করে পটুয়াখালী থেকে পালিয়ে যায় পাকবাহিনী। ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় পটুয়াখালী।

বরিশাল : ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে ডেরা গুটিয়ে বরিশাল ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ৭ ডিসেম্বর বিকাল ৪টা থেকে বরিশালে কারফিউ জারি করেছিল পাকবাহিনী। সীমান্তে মিত্রবাহিনী আক্রমণ শুরু করলে ওই দিন সন্ধ্যায় পাক সেনারা বরিশাল ত্যাগের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যাত্রীবাহী স্টিমার ইরানি, কিউইসহ লঞ্চ ও কার্গোতে করে পাকবাহিনী, পাক মিলিশিয়াসহ শহরের দালাল ও রাজাকার কমান্ডাররা বরিশাল ত্যাগ করে। তবে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় চাঁদপুরের কাছে মেঘনা মোহনায় পাক সেনাবাহিনীর কিউই জাহাজসহ গানবোড ও কার্গো ধ্বংস হয়। অন্য নৌযানগুলো বরিশালের কদমতলা নদীতে ভারতীয় বিমানের বোমা হামলায় ডুবে যায়। এতে পলায়নরত পাকসেনা ও তাদের দোসররা নিহত হয়।

কালকিনি : মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা মরণ কামড় বসায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ঘাড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরো সময় এ উপজেলা ছিল পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণে ক্ষতবিক্ষত। বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়েকটি মুখোমুখি যুদ্ধসহ ১৫টি দুঃসাহসিক অভিযান চালান মুক্তিযোদ্ধারা। একের পর এক ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে থাকলে ৮ ডিসেম্বর কালকিনি ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।

আজমিরীগঞ্জ : ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয়েছিল তৎকালীন ভাটি বাংলার রাজধানী খ্যাত হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ থানা। সেদিন মেঘনা রিভার ফোর্সের কোম্পানি কমান্ডার, ভারতের ঢালু ক্যাম্পের ১১ নম্বর সেক্টরের ট্রেনিং ইনচার্জ ফজলুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ৭ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধ শেষে পূর্বাকাশে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই পাকসেনা ও তাদের দোসরদের হটিয়ে মুক্ত করেন আজমিরীগঞ্জ। সেদিন মুক্তিকামী জনগণ ফুলের মালা দিয়ে বরণ কওে নেয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।

সর্বশেষ খবর