রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব

পুলিশের আইজি র‌্যাবের ডিজিসহ সাত কর্মকর্তার নিষেধাজ্ঞার ব্যাখ্যা চেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব

র‌্যাবের বর্তমান ও সাবেক ছয় কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে তলব করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গতকাল সকালে মন্ত্রণালয়ে হাজির হলে রাষ্ট্রদূতের কাছে বাংলাদেশ সরকারের অসন্তোষের কথা জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বিকালে আনুষ্ঠানিকভাবে তলবের তথ্য এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলবের ঘটনা এটাই প্রথম। অবশ্য এর আগে কখনো বাংলাদেশের কোনো সংস্থা বা বাহিনীর কর্মকর্তাকেও এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়নি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শুক্রবার সংস্থা হিসেবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব ও এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের মতো ঘটনার দায় দিয়ে র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হিসেবে বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মোস্তাফা সরোয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আনোয়ার লতিফ খানের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট।

এ ঘটনায় শুধু মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব নয়, গতকাল এ নিষেধাজ্ঞাকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং বলে অভিহিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, বাংলাদেশের সিস্টেমে কেউ ইচ্ছা করে ক্রসফায়ার করতে পারে না। র‌্যাবের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ সত্য নয়। কারণ র‌্যাব মানবাধিকার হরণ নয়, বরং র‌্যাব মানবাধিকার রক্ষার কাজ করে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে তলব করার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কোনো ধরনের পূর্ব-আলোচনা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় বাংলাদেশ হতাশ। পররাষ্ট্র সচিব এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে দুই দেশের চলমান আলোচনার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তারপরও কোনো আলোচনা ছাড়াই ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার ও অন্যান্য ঘৃণ্য আন্তসীমান্ত অপরাধ দমনের কাজ করা সরকারের একটি সংস্থার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে দুঃখজনক বলেন পররাষ্ট্র সচিব। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগগুলোর বিষয়ে তথ্যভিত্তিক ব্যাখ্যা ও ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য নেওয়া পদক্ষেপগুলো ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন নয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংস্থাকে কয়েক দফায় জানানো হয়েছে। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের পদক্ষেপ দুঃখজনক। পররাষ্ট্র সচিব এ সময় মন্তব্য করেন, স্থানীয় পর্যায়ে ঘটে যাওয়া কিছু অপ্রমাণিত অপরাধের বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের ওপর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’-এর মতো ভয়াবহ আন্তর্জাতিক অপরাধ সংঘটিত করাদের সঙ্গে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় পুনরায় দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্র সচিব। মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে কিছু আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। র‌্যাবও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেপরোয়া সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। সেখানে একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আলাদা করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলোচনার সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলার বাংলাদেশ সরকারের উদ্বেগের বিষয়টিকে আমলে নিয়ে তা ওয়াশিংটনে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরার আশ্বাস দিয়েছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আরও বলেনছেন, দুই দেশের মধ্যে আলোচনার বিদ্যমান কাঠামো এবং উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে চমৎকার ও বহুমাত্রিক এই সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ রয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মার্কিন সরকারের ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকতে চাওয়ার সদিচ্ছার বিষয়টিও আর্ল মিলার উল্লেখ করেছেন বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঢং বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : র‌্যাব কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে ‘খুবই দুঃখজনক’ পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তবে এ ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন তিনি। গতকাল সকালে ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠান শেষে তিনি এ কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আমাকে ফোন করলেন এবং জানালেন যে, বাইডেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন একটা নতুন নিয়ম করেছে। এটা তাদের নতুন ঢং। তারা যখন কোনো সংস্থাকে লিস্টেড করে তখন ওখানে যারা প্রধান হিসেবে কাজ করে তাদের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক। এ খবর জানার পর যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, পররাষ্ট্র সচিব তার সঙ্গে আলাপ করেছেন। তিনিও অনেকটা সারপ্রাইজডের মতো। এখন দেখি আর কী হয়। এতে সম্পর্কের দিক দিয়ে কোনো প্রভাব পড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমার মনে হয় না। তবে এটা নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর, ওরা বলতে পারে। তবে এটুকু বলি, যে দেশগুলো উন্নতি করে, যে দেশের সরকার অনেক ভালো কাজ করে, অনেক সময় তাদের ওপর আক্রমণ হয়। আপনি ভালো কাজ করলে তখন সমস্যা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাল্টা অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমেরিকাতে প্রতিবছর ছয় লাখ লোক নিখোঁজ হয় এবং তারা কীভাবে নিখোঁজ হয়, আমেরিকান সরকার জানে না। আর প্রতিবছর পুলিশ হাজারখানেক লোক মেরে ফেলে। আমেরিকাতে এই যে ছয় লাখ লোক নিখোঁজ হয়, তার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার প্রধানের তো কোনো শাস্তি হয় না। আর বাংলাদেশে নাকি ১০ বছরে এই ৬০০ জনকে র‌্যাব মেরেছে। কাকে মেরেছে, তার তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা আশা করব, তারা আরও তথ্যভিত্তিক হবে বলে মন্তব্য করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

আমাদের সিস্টেমে কেউ ইচ্ছা করে ক্রসফায়ার করতে পারে না- স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : দেশে ক্রসফায়ারের মতো ঘটনাগুলোর পেছনে যথাযথ কারণ ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়েছে এমন মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে ওয়াসা ভবনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এমন মন্তব্য করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের সিস্টেম খুবই সুন্দর। কাজেই এই সিস্টেমে কেউ ইচ্ছা করে ক্রসফায়ার বা ইচ্ছা করে গুলি করতে পারেন না। তিনি বলেন, সব ঘটনার পেছনে যথাযথ কারণ ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়েছে বিগত দিনে। আসাদুজ্জামান খান বলেন, এসব ঘটনা শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশেই এগুলো চলছে এবং চালু আছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এটা আমাকে দেখতে হবে। তারা কেন, কীভাবে, কী কারণে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। সেটি না দেখে আমি পুরো মন্তব্য করতে পারব না।

যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ সত্য নয়- ্যাব : র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্য নয়। র‌্যাবের মতো মানবিকতা বিশ্বের খুব কম বাহিনীই দেখিয়েছে। র‌্যাব মানবাধিকার লুণ্ঠন করে না, মানবাধিকার রক্ষা করে। এখন পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে যা কিছু জেনেছি, তার সবই গণমাধ্যম থেকে পাওয়া। আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানাবে। গতকাল রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। একটি চুরির ঘটনা উদ্ঘাটন নিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার যে অভিযোগের কথা উঠেছে সে সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির মুখপাত্র বলেন, বিভিন্ন সময় গুলিবিনিময় বা ক্রসফায়ার নিয়ে অভিযোগ ওঠে। আত্মরক্ষার অধিকার আইন দিয়েছে। মাদক ও জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে আমরা যখন প্রতিরোধের শিকার হয়েছি, যখন গুলি চালিয়েছে তখনই আমরা গুলি করেছি। গুলিবিনিময়ে অফিসার ও বিভিন্ন সদস্য শহীদ হয়েছেন। র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাবের লে. কর্নেল আজাদসহ ২৮ জন জীবন দিয়েছেন। মানবাধিকার রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে র‌্যাবের ১ হাজারের অধিক সদস্যের অঙ্গহানি হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা সমুন্নত রাখার জন্য ২ হাজারের বেশি সদস্য বিভিন্নভাবে আহত হয়েছেন। র‌্যাবের তত্ত্বাবধানে ৪২১ জন জলদস্যু ও জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। বিশ্বে এমন কোনো ফোর্স নেই, যার সদস্য সংখ্যা ৯ হাজার। তাদের মধ্যে আমি যে পরিসংখ্যান দিলাম, দেশের আইনশৃঙ্খলা মানবাধিকার রক্ষার্থে এভাবে আত্মত্যাগ করেছে কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর