বুধবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিজয়ের আগের দিন হানাদারমুক্ত হয় যেসব এলাকা

প্রতিদিন ডেস্ক

বিজয়ের আগের দিন হানাদারমুক্ত হয় যেসব এলাকা

আজ ১৫ ডিসেম্বর। বিজয়ের আগের দিন। ১৯৭১ সালের এদিন পাক হানাদারবাহিনীকে বিতাড়িত করা হয় সিলেট, গাজীপুর, খাগড়াছাড়ি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে।

সিলেট : হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরান (রহ.)-এর পুণ্যভূমি সিলেট থেকে হানাদারবাহিনীকে বিতাড়িত করা হয় ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। এ দিনটি সিলেট মুক্ত দিবস। এদিনে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীসহ মুক্তিকামী জনতার প্রতিরোধে পাকসেনারা পরাস্ত হয়। সিলেটবাসীর কাছে এ দিনটি গৌরবোজ্জ্বল ও বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর পাকসেনারা চলে আসে শহরের উত্তরদিকে সালুটিকর এলাকায়। ১৩ ডিসেম্বর শহরের পূর্বদিকে খাদিমনগর এলাকায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর একটি দল পৌঁছে যায়। ১৪ ডিসেম্বর, মাছিমপুরের পশ্চিম পাশে পাকিস্তানি বাহিনী আর মেন্দিবাগের রাস্তার উল্টোদিকে মুক্তিবাহিনীসহ মিত্রবাহিনী। বিকাল গড়িয়ে যাচ্ছে। শুরু হয়েছে তুমুল যুদ্ধ। প্রচণ্ড গোলাগুলির একপর্যায়ে হেলিকপ্টার করে দুবড়ির হাওরে (বর্তমান উপশহর) মিত্রবাহিনীর সৈন্য নামে। মর্টার সেলের শব্দে কান ঝালাপালা। আগের রাতেও প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এখানে মুক্তিবাহিনীর অনেকে শহীদ হন। এ সময়ের মধ্যে চারদিকে ঘিরে ফেলা হয় হানাদারবাহিনীকে। দিন গড়িয়ে যাওয়ার একপর্যায়ে পাকবাহিনী বর্তমান শাহজালাল ব্রিজের কাছে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করে। রাত পোহানোর সঙ্গে সঙ্গে শহরজুড়ে উত্তেজনা। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো এমসি কলেজ মাঠে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। আর এদিন পাকিস্তানি বাহিনী পড়ন্ত বিকালে অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। পরে দেওয়ান ফরিদগাজী আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সিলেট মুক্ত’ ঘোষণা দেন।

খাগড়াছাড়ি : ১৯৭১ সালের আজকের দিনে খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়েছিল। সবশেষ ১৪ ডিসেম্বর গাছবান কুকিছড়ায় পাকবাহিনীকে হাটিয়ে ১৫ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির সবচেয়ে উঁচু স্থান এসডিও বাংলোর সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওই দিন সকাল সাড়ে ১০টায় খাগড়াছড়িতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দোস্ত মোহাম্মদ চৌধুরী। এ সময় গ্রুপ কমান্ডার অশোক চৌধুরী বাবুল, মংসাথোয়াই চৌধুরী, জুলু মারমাসহ অনেকেই সঙ্গে ছিলেন। এর আগে ২৭ এপ্রিল মহালছড়িতে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। পরে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতায় করায় মহালছড়িতে চিত্তরঞ্জন চাকমাসহ চার পাহাড়িকে হত্যা করে পাকবাহিনী।

গাজীপুর : ১৯৭১ সালের এদিনে গাজীপুর মহানগরীর ছয়দানা এলাকায় জেলার সবশেষ সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে পরাজিত করা হয়। সেই সঙ্গে এতে পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের ভারী অস্ত্র ও যানবাহন ধ্বংস এবং বহু সেনা নিহত হয়। মুক্ত হয় গাজীপুর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চূড়ান্ত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ১৯ মার্চ গাজীপুরের মাটিতে সর্বপ্রথম হয়েছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ। তাই সে সময় সারা দেশে স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ?আবার বিজয় লাভের পূর্বক্ষণে ১৫ ডিসেম্বর এ গাজীপুরের মাটিতেই সংঘটিত হয়েছিল হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সবশেষ বড় ধরনের সম্মুখযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল গাজীপুরে।  জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা, রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপোসহ বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল গাজীপুর। তাই পাকিস্তানিদের বড় ধরনের আঘাত হানতে এ জেলা দখল নেওয়াটা ছিল সে সময়ের দাবি। সে কারণেই নভেম্বরের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা চতুর্মুখী গেরিলা অভিযানে জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা, রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপোসহ পাকিস্তানি বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানে পরিকল্পিত আক্রমণ শুরু করে। এতে ভীতসন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান গুটিয়ে নিয়ে সেনাঘাঁটিতে একরকম অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা ১৩-১৪ ডিসেম্বর গাজীপুর সেনানিবাসে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায়। টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা ফিরে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। তারা জয়দেবপুর সেনানিবাস, সমরাস্ত্র কারখানা এবং অর্ডন্যান্স ডিপো থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে চান্দনা চৌরাস্তায় জড়ো হতে থাকে। ১৫ ডিসেম্বর চান্দনা চৌরাস্তায় জড়ো হওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ঢাকার পথে রওনা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছয়দানা ও টঙ্গীতে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনীর বহর মহানগরীর ছয়দানা এলাকায় পৌঁছলে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ। অন্যদিকে কাশিমপুরে অবস্থান নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বড় একটি দল ও মিত্রবাহিনী কামান ও মর্টারের  গোলাবর্ষণ করতে থাকে। গভীর রাত পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর গোলাবর্ষণে পাকিস্তানি বাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বহু সেনা নিহত হয়। বিধ্বস্ত হয় ট্যাংক, কামান, মর্টারসহ তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন। শত্রুমুক্ত হয় গাজীপুর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : ১৯৭১ সালের এদিনে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর হাতে অবরুদ্ধ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাকে মুক্ত করে। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, গোলাম নবী সাটুসহ নাম না জানা লাখ লাখ শহীদ মরণপণ যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করেন উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ।

মুক্তিযুদ্ধে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন। ৭ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান চৌধুরী। তার নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় এ অঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে শুত্রু মোকাবিলার যুদ্ধ। ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমায় ছিল দুটি সাব সেক্টর। একটি মোহদিপুর সাব সেক্টর অন্যটি দলদলী সাব সেক্টর। মোহদিপুর সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর এবং দলদলী সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন লে. রফিক।

’৭১-এর মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হলেও প্রথমদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুদ্ধের তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। ১৯ এপ্রিল রাতে শহরে বোমা বিস্ফোরণ করে আতঙ্ক সৃষ্টি করে পাকবাহিনী। শহর দখল করে ব্যাপক ধ্বংষযজ্ঞ চালায় তারা। তারপরই পাকবাহিনীকে প্রতিহত করতে সংগঠিত হতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় প্রশিক্ষণ নিতে ভারতেও পাড়ি জমান অনেকে। শেষের দিকে জেলার বেশ কিছু স্থানে সম্মুখযুদ্ধে আহত ও নিহত হন অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৭ নভেম্বর লে. রফিকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মকরমপুর ও আলীনগর পাক ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালালে পাঁচ পাক সেনা নিহত হয় ও অন্যরা মহানন্দা নদী পার হয়ে পালিয়ে যায়। অপরদিকে ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা চরবাগডাঙ্গা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য অগ্রসর হন এবং পাকসেনাদের বাংকার দখল করে নেন। ১৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং ওই দিন মুক্তিযোদ্ধারা সাঁড়াশি আক্রমণ চালান পাকসেনাদের বিরুদ্ধে। সেদিন রাতে হরিপুর ব্রিজের কাছে সংঘটিত যুদ্ধে শহীদ হন ইপিআর নায়েক নবির উদ্দীনসহ ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা। এতে ৯ জন গ্রামবাসীও নিহত হন।

দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর জেলা শহরের মহানন্দা নদীর পাদদেশ রেহাইচর এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে বীরের মতো নিহত হন বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। এ খবর পেয়ে ৭ নম্বর সেক্টরের যোদ্ধারা কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং পরে ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীন, লে. রফিকুল ইসলাম, লে. আব্দুল কাইয়ুম খান স্ব-স্ব বাহিনী নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর বিকালে আবারও তুমুল যুদ্ধে নেমে পড়েন। গভীর রাতে শেষ হয় সেই যুদ্ধ। পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় উদ্ধার করা হয় ক্যাপ্টেনের লাশ এবং তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদে নিয়ে গিয়ে তার লাশ সমাহিত করেন মুক্তিযোদ্ধারা এবং শত্রুমুক্ত হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর।

পার্বতীপুর : ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের পর সারা দেশের মতো দিনাজপুরের পার্বতীপুরেও শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ব্যবসা বাণিজ্য, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় রেল যোগাযোগ। মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর প্রতিরোধের মুখে পাকহানাদার বাহিনী পার্বতীপুর এলাকা থেকে পালিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পার্বতীপুর হানাদারমুক্ত হয়। এর আগে দিনাজপুরের প্রত্যেক উপজেলা মুক্ত হয়।

সর্বশেষ খবর