রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

২ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের অপারেশন, দুর্ধর্ষ চুরি দুই সোনার দোকানে

নিজস্ব প্রতিবেদক

২ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের অপারেশন, দুর্ধর্ষ চুরি দুই সোনার দোকানে

কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মার্কেটে সোনার দোকানে চুরির পর পড়ে আছে শুধু খালি তাক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অপারেশন ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের। শুক্রবার দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিট থেকে ভোর ৬টা ২৫ মিনিট। ঘটনাস্থল রাজধানীর কাকরাইলে কর্ণফুলী গার্ডেন সিটি মার্কেট। এ মার্কেটের চতুর্থ তলার ‘মোহনা জুয়েলার্স’ ও ‘জুয়েল এভিনিউ’ নামের দুটি সোনা ও হীরার দোকানে দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটায় দুই সদস্যের চোর দল। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রায় ৭  কোটি টাকার সোনা ও হীরার অলঙ্কার এবং নগদ সাড়ে ৮ লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে গেছে চোরেরা।

তবে পালিয়ে যাওয়ার সময় পার্শ্ববর্তী ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীদের ধাওয়ায় ২০ ভরি সোনার অলঙ্কারের একটি ছোট ব্যাগ ফেলে পালিয়ে যায় তারা। খবর শুনে প্রথমে ঘটনাস্থলে যায় রমনা থানা পুলিশ। একে একে র‌্যাব, সিআইডি ও পিবিআইর সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনার রহস্য উদ্্ঘাটনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজন নিরাপত্তারক্ষীকে রমনা থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ।

রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে থানায় নেওয়া হয়েছে। আমাদের একাধিক টিম এ নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি শিগগিরই আমরা রহস্য উদ্্ঘাটন করতে পারব।’

গতকাল দুপুরে সরেজমিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সবকিছু হারিয়ে ভুক্তভোগীরা দোকানের সামনে হাউমাউ করে কাঁদছেন। মার্কেটের অনেক ব্যবসায়ী মোহনা জুয়েলার্সের মালিক তপন গুপ্ত ও জুয়েল এভিনিউয়ের মালিক বিপ্লব রায়ের পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তবে কিছু সময় পর পর তপন গুপ্তের স্ত্রী ডুকরে কেঁদে উঠছেন।

মোহনা জুয়েলার্সে শাটারে লাগানো তালার হুকগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। শাটার খোলার পর কাচের গ্লাস ভেঙে দোকানে প্রবেশ করে চোর। এ ছাড়া জুয়েল এভিনিউয়ে শাটারের তালা ভাঙা হয়েছে। দোকান দুটির শোকেসে সাজিয়ে রাখা প্রায় সব অলঙ্কারই লুট করে নেওয়া হয়েছে। মোহনা জুয়েলার্সের পাশেই মার্কেটের টয়লেটের এক্সট্রাকশন ফ্যান খুলে রাখা আছে। টয়লেটের দরজাটি মার্কেটের ভিতরের দিক থেকে তালা দেওয়া থাকলেও ভিতর থেকে নাট খুলে দরজা খুলে ফেলা হয়েছে।

২০০৪ সালে একই মার্কেটের তৎকালীন মহানগর জুয়েলার্স ও সুলতানা জুয়েলার্সেও ভয়াবহ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। মহানগর জুয়েলার্সের মালিক ছিলেন তপন গুপ্তরা তিন ভাই। সেই শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন তারা। তবে ১৭ বছরের ব্যবধানে আবারও তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটল। মার্কেটের পার্শ্ববর্তী নির্মাণাধীন গাউসিয়া-২ ভবনে গিয়ে দেখা যায়, এ ভবনটি একেবারেই লাগোয়া কর্ণফুলী মার্কেটের সঙ্গে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, নির্মাণাধীন এই ভবন ব্যবহার করেই চোরেরা কর্ণফুলী মার্কেটে প্রবেশ করে।

তপন গুপ্ত ও নির্মল গুপ্ত নামে দুই ভাই ৪/৩৬ নম্বর মোহনা জুয়েলার্সের মালিক। বংশপরম্পরায় তারা সোনার ব্যবসা করে আসছেন। তপন গুপ্ত এ প্রতিবেদককে বলছিলেন, তার দোকান থেকে অন্তত সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ ভরি সোনা চুরি করে নিয়ে গেছে চোরেরা। এ ছাড়া দোকানের ক্যাশ থেকে নগদ প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা লুট হয়েছে। কথা বলতে বলতে কেঁদে যাচ্ছিলেন তপন গুপ্ত। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘অনেক কাস্টমার স্বর্ণালঙ্কার রিপেয়ার করতে, আবার অনেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে গেছেন। গতকাল সকালেও একজন ৫ লাখ টাকা দিয়ে গেছেন। আমার তো আর কিছুই রইল না। আমি লোকজনকে এখন কীভাবে সোনা ফেরত দেব, তাদের কী বলব!’

তিনি বলেন, ‘সকালবেলা ময়লাওয়ালা এসে দেখে তালা ভাঙা। তারপর তারা মার্কেট কর্তৃপক্ষকে জানায়। এরপর তারা আমাদের বিষয়টি জানায়। এসে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে।’ পাশেই তার স্ত্রী ও সন্তান তুষার গুপ্ত হাউমাউ করে কাঁদছিলেন।

বংশগতভাবে সোনার ব্যবসা করা জুয়েল এভিনিউর মালিক বিপ্লব রায় বলেন, ‘আমি নিজে ২২ বছর ধরে এই দোকান পরিচালনা করছি। এর আগে আমার বাবা-দাদা একই ব্যবসা করেছেন। আমার দোকানে লুট হওয়া অলঙ্কারের ভরির হিসাব করা যাবে না। অনেক দিন ধরেই আমি মালামাল মিলিয়ে দেখিনা। দোকানের সোনা আর ডায়মন্ডের অলঙ্কারগুলো নিয়ে গেছে। অন্তত পৌনে ৪ লাখ টাকা নগদসহ ৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। চোর সব নিয়ে গেলেও রুপার অলঙ্কারগুলো ধরেনি। এ থেকে বোঝা যায় যারা এসেছে তারা নিশ্চয়ই সব জানে এবং অভিজ্ঞ।’

ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আলোচনার জন্য এসেছিলেন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সহ-সভাপতি ডা. দেওয়ান আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালেও একবার একই মার্কেটের সুলতানা জুয়েলার্স ও মহানগর জুয়েলার্সে চুরির ঘটনা ঘটেছিল। এভাবে প্রায়ই বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকার সোনার দোকানে চুরি হচ্ছে। দোকান মালিকদের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা মামলা হচ্ছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানাব, সোনার দোকানে চুরির ঘটনাগুলো কোনো একটি সংস্থার কাছে তদন্তের ভার দেওয়ার। তাহলে হয়তো একটা চুরির সঙ্গে আরেকটার লিংক খুঁজে পাওয়া যাবে।’

তিনি বলেন, এই মার্কেটের সবচেয়ে বেশি গয়নার ও জাঁকজমক দোকান হচ্ছে মোহনা জুয়েলার্স। এই দোকান এবং পাশের আরেকটি দোকানে চুরি হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় এটি পূর্বপরিকল্পিত এবং জড়িতরা আগে থেকেই ভালোভাবে রেকি করেছে।

এ প্রতিবেদকের কাছে আসা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে হাফ প্যান্ট পরিহিত দুজন চোর প্রবেশ করে মার্কেটের পঞ্চম তলায়। দুজনের হাতেই ছিল ভারী কিছু যন্ত্রপাতি। এগুলো দিয়েই তারা টয়লেটের অ্যাকজস্ট ফ্যান ভেঙে টয়লেটের ভিতরে প্রবেশ করে। পরে টয়লেটের দরজা ভেঙে মার্কেটে প্রবেশ করে। এরপর তারা একে একে শুরু করে দুটি দোকানে ভয়াবহ চুরির অপারেশন। চোরেরা জুয়েল এভিনিউয়ের সামনে থাকা একটি সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে ফেলে ফ্রি স্টাইলে চুরি করে। ভোর ৬টা ১২ মিনিটে তারা মার্কেট ত্যাগ করে। যাওয়ার সময় পার্শ্ববর্তী নির্মাণাধীন গাউসিয়া-২ ভবনের নিরাপত্তা দেয়াল টপকে পালিয়ে যায় তারা।

কর্ণফুলী মার্কেট মালিক সমিতির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মোখলেসুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, কর্ণফুলীর পক্ষ থেকে কয়েক দফা পার্শ্ববর্তী গাউসিয়া-২ ভবনের নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে রাজউক ও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছিল। তবে গাউসিয়া কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা নিশ্চিত হয়েছেন যে পার্শ্ববর্তী ভবন দিয়েই চোরেরা কর্ণফুলী মার্কেটে প্রবেশ করে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের একজন সুপারভাইজারের নেতৃত্বে আটজন নিরাপত্তারক্ষী সার্বক্ষণিকভাবে মার্কেটের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকে।’

ইঞ্জিনিয়ার মো. মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে মার্কেটের নিরাপত্তায় একজন সুপারভাইজার আছেন। আর আমাদের সব সিকিউরিটি গার্ডই নিজেদের নিয়োগ দেওয়া। তারা সার্বক্ষণিক এখানে থাকেন ও দায়িত্ব পালন করেন।’

র‌্যাব-৩ অধিনায়ক উইং কমান্ডার কামরুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনার খবর পাওয়ার পরপরই আমাদের একাধিক টিম এ নিয়ে কাজ করছে। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছি।’

ঢিলেঢালা নিরাপত্তাব্যবস্থা : ২০০৪ সালেও এই মার্কেটে সুলতানা জুয়েলার্স ও মহানগর জুয়েলার্সে ভয়াবহ চুরির ঘটনা ঘটে। সে সময় সুলতানা জুয়েলার্স থেকে সাড়ে ৪ হাজার ভরি এবং মহানগর জুয়েলার্স থেকে ২৪০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এরপর সতর্কতা হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তাব্যবস্থা সাজানো হয় বলে দাবি করেন মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন টিটো। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মার্কেট বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণফুলী মার্কেটের প্রতিটি দোকানের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে প্রতিটি দোকানের অভ্যন্তরে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো আর কাজ করে না। এ কারণে মোহনা জুয়েলার্স ও জুয়েল এভিনিউর অভ্যন্তরে থাকা ক্যামেরাগুলোতে কোনো ফুটেজ আসেনি।

এ ব্যাপারে দোকান মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিটো বলেন, আসলে তিন বছর আগে মার্কেটে আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে কার্যকরী কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহ ক্ষতি থেকে বাঁচতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে মার্কেটের অভ্যন্তরে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো আলাদা আইপিএস সংযোগের মাধ্যমে সচল রাখা হয়।

তিনি বলেন, ২০০৪ সালে চুরির পর জানা যায়, জড়িতরা ঘটনার কয়েক মাস আগে মার্কেটে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আগে সিকিউরিটির লোকজন রাতে মার্কেটের ভিতরে থাকত। এরপর থেকে সিদ্ধান্ত হয় রাতে মার্কেটের ভিতরে কেউ থাকবে না। সব দোকান বন্ধ করার পর দুজন দোকানগুলো চেক করে আসেন এবং সব শেষে সুপারভাইজার চেক করে মেইন গেট বন্ধ করে দেন। রাতে মার্কেটের বাইরে সিকিউরিটি গার্ডরা থাকলেও ভিতরে কেউ থাকেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মার্কেটের এক নিরাপত্তারক্ষী বলেন, ‘আমরা রাতে মার্কেটের বাইরে দায়িত্বে থাকি। চারতলায় কী হয়েছে তা আমাদের জানার কথা নয়। এ ছাড়া কোনো শব্দও পাইনি আমরা।’

সর্বশেষ খবর