বিভিন্ন দিবস পালন ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রটোকল প্রদানেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো। ফলে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক সরকারবিরোধী অপতৎপরতা ঠেকাতে ব্যর্থতার দায়ও দেওয়া হচ্ছে দূতাবাসগুলোকে। আর নতুন বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও শ্রমবাজার তৈরি, বিদেশে আপদে-বিপদে বাংলাদেশিদের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে কূটনৈতিক মিশনগুলোর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা না রাখতে পারার অভিযোগ বেশ পুরনো। এমনকি বিদেশবিভুঁইয়ে খেটে-খাওয়া মানুষগুলো নিজ দেশের দূতাবাসে গিয়ে ভোগান্তি-দুর্ব্যবহারের শিকার হওয়ার অভিযোগ করছেন ক্রমাগতই।
সরকারি দলের একাধিক নেতার অভিযোগ, বাংলাদেশ ও সরকার নিয়ে বিদেশে বসে একটি মহল নানান ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে আল-জাজিরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সরকারকে বিব্রত করেছিল। শুধু ওই প্রতিবেদন নয় আলজাজিরা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে যাচ্ছে। সরকারের একাধিক নেতাকে ডেকে অযাচিত ভঙ্গিতে আক্রমণও করছে। আলজাজিরা সরকারকে আক্রমণ করতে গিয়ে দেশের ভাবমূর্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলছে। কিন্তু কয়েক বছর গড়িয়ে গেলেও আলজাজিরায় পজিটিভ বাংলাদেশের কোনো চিত্র উঠে আসেনি। দূতাবাসগুলোর ব্যর্থতার কারণেই এটা সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন সরকারদলীয় এই নেতারা। তাদের মতে, সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, দেশের সর্বোচ্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা আইজিপি ও র্যাবের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশকেই চাপে ফেলে দেওয়া হয়েছে। অনেকটা আকস্মিকভাবে সরকার এই নিষেধাজ্ঞার কথা জানতে পারে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ন্যক্কারজনক পরিস্থিতি যে তৈরি হচ্ছে সে বিষয়ে সরকারের কাছে আগাম কোনো বার্তা দেয়নি কেউ। নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর ব্যবস্থা আসতে পারে তা সহজবোধ্যভাবে পৌঁছানো হয়নি সরকারের কাছে। আর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে কংগ্রেসম্যান দিনের পর দিন তৎপর ছিলেন তাকে শান্ত করার বিষয়েও কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দূতাবাসগুলোকে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে- নানান ধরনের দিবস পালন ও প্রটোকল দেওয়ার মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রেখেছে দূতাবাসগুলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজস্ব কমপ্লেক্সে দূতাবাসের লোকজন নিয়ে আলোচনা, ফটোসেশন ও পরিবারসহ খাওয়া-দাওয়ার মাধ্যমেই পালন হচ্ছে এসব দিবস। এসব অনুষ্ঠানে আগের মতো হোস্ট কান্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের উপস্থিতিও প্রায় নেই বললেই চলে। শুধু করোনাভাইরাসের মহামারীর মধ্যেই নয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পর পরপর একাধিক দিবস পালন হয়েছে ফটোসেশনের আনুষ্ঠানিকতায়। মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানগুলোতেও সেভাবে বিদেশিদের সম্পৃক্ত না করেই দায়সারাভাবে পালন করতে দেখা গেছে দূতাবাসগুলোকে। অন্যদিকে, বৈশ্বিক মহামারীতে বেশ খানিকটা সময় বন্ধ থাকলেও এর আগে পরে ‘ভিআইপি’ বা ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের’ প্রটোকল দেওয়া নিয়েই বেশি ব্যস্ত থেকেছে বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলো। কূটনৈতিক কর্মকান্ডের চেয়ে দূতাবাস ও হাইকমিশনগুলোয় নিয়োজিতদের বেশি সময় কেটেছে প্রটোকলের পেছনেই। প্রটোকলই প্রধান কাজে পরিণত হয়েছিল কয়েকটি মিশনে। এ মিশনগুলোর এক বা একাধিক কর্মকর্তাকে দিনের পর দিন কাটাতে হয়েছে এয়ারপোর্টে। আকাশপথে স্টপওভার বেশি থাকা দেশগুলোতে মাঝে মাঝে প্রটোকলের চাপে মিশনের স্বাভাবিক কর্মকান্ড চালানোও দুষ্কর হয়ে পড়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।কূটনীতিকদের অভিযোগ, রাজনৈতিক কারণে প্রটোকলের এই সীমা ছাড়িয়ে যায়। সব মন্ত্রীই বিদেশে ‘পূর্ণ’ মর্যাদা চান। তারা ট্রানজিট বিমানবন্দরগুলোয় স্বল্প সময় কাটালেও সেখানে নানান ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয় দূতাবাসকে। এমনকি সরকারি দলের প্রভাবশালী এমপিরাও চান নানান সুবিধা। না পেলে সম্মানহানির অভিযোগ করা হয়। যে দূতাবাসের ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ উঠবে, সেখানে কর্মরতদের ‘বিরোধী দলের সমর্থক’ বলার ঘটনাও রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রায়শই টেলিফোনে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজনদের প্রটোকল দিতে বাধ্য করা হয় মিশন কর্মকর্তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘটনা এক দিনে হয়নি। দূতাবাস ও কূটনীতিকদের কারণেই এই যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ দিনের পর দিন পেছানো সম্ভব হয়েছে। কারণ এ নিয়ে আলোচনায় নিয়ে আসা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের। এর মধ্যে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের চাপে হঠাৎ করে কঠোর সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে। আর র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার হরণের বিদেশি অভিযোগের বিষয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী-উপদেষ্টা বিভিন্ন সময়ে জ্ঞাত ছিলেন। তারাও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে জবাব ও আশ্বাস দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া আশ্বাস পূরণ করা হয়নি। এসব আশ্বাস পূরণের ক্ষমতা দূতাবাস তো দূরের কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারের মধ্যেও নেই। তারপরও নানান সময়ে দূতাবাস অবহিত করায় সংশ্লিষ্ট স্থানে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে গ্রাউন্ড পরিস্থিতি পরিবর্তন না হলে দেশের বাইরে থেকে শত চেষ্টা করেও অনেক কিছুই করা যায় না। হোস্ট কান্ট্রির চাহিদা ও আদর্শ অবস্থা নিশ্চিত না হলেও সময়ক্ষেপণ করা যায় কিন্তু পরিণতি ঠেকানো যায় না। এটা মানবাধিকার থেকে বিনিয়োগ সব ক্ষেত্রেই একই।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাণিজ্যিক উইংয়ের ব্যর্থতা চলছেই : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রপ্তানি খাত। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত মূলত তৈরি পোশাকনির্ভর। এখন যেসব দেশ বাংলাদেশকে শুল্ক সুবিধা দিচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর একসময় আর সে সুবিধা দেবে না। তখনই আসল চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। আর এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে বিদেশে বাংলাদেশের পণ্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মিশনগুলো বর্তমানে যে পদ্ধতিতে কাজ করছে তা যথার্থ নয়। জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ৫৭টি দেশে পণ্য ও সেবা রপ্তানি হয়ে থাকে। এসব দেশে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে অর্জিত হয় রপ্তানির সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রা। বিদেশে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলোতে আবার গুরুত্ব বুঝে বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক উইং রয়েছে। এসব উইংয়ের কাজই হলো সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা। কিন্তু বেশিরভাগ উইং কাজটি সঠিকভাবে করতে পারছে না। রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয় না অর্ধেকের বেশি মিশনে। লেবার উইংয়ে অনীহা শ্রমিকদের : দূতাবাসে প্রয়োজনীয় সেবা না পাওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারছে না বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম উইংগুলো। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে এখন দূতাবাসমুখীই হন না প্রবাসীরা। আইএলওর ‘দ্য হোমকামিং : প্রোফাইলিং দ্য রিটার্নিং মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিদেশে অবস্থান করা প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশই কোনো সমস্যায় পড়লে স্থানীয় দূতাবাসের সহায়তা নেন না। প্রবাসী খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের ২৫টি দেশে বাংলাদেশের ২৯টি শ্রম উইং রয়েছে। তবে এসব শ্রম উইংয়ে পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছেন না। ফলে নানাভাবে তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।