মঙ্গলবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র থাকলেই কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

গণতন্ত্র থাকলেই কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়

আকবর আলি খান

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য গণতন্ত্র প্রয়োজন আর গণতন্ত্র থাকলেই কেবল সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে যে চার নীতির ওপর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এর অন্যতম ছিল গণতন্ত্র। এ ক্ষেত্রে কতটা অর্জন হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। দেশের সবাই উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চান- যেখানে থাকবে সুষ্ঠু নির্বাচন, প্রতিষ্ঠিত থাকবে আইনের শাসন, থাকবে কথা বলার অধিকার। অর্থনীতির গভীর এই বিশ্লেষক বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। ১৯৭১ সালে যেখানে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ, এখন তা ২০ শতাংশে নেমেছে। এটা অকল্পনীয় অর্জন। তবে তিন দশক ধরে বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বেড়েছে, যার পেছনে দুর্নীতি ও কালো টাকার প্রবাহ ছাড়াও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে।

গতকাল রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তিনি। এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান বীর বিক্রম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিজিএস চেয়ারম্যান মনজুর এ চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান। অনুষ্ঠানে সিজিএস আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।

সাবেক সচিব আকবর আলি খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন রয়েছে, তাতে মানুষে মানুষে বিভেদ কমার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে বিভেদ বেড়েই চলেছে। এই বৈষম্য বেড়েছে গত ২৫ থেকে ৩০ বছরে। এর একটি কারণ হচ্ছে, দেশে প্রচন্ড দুর্নীতি চলছে। এই দুর্নীতির ফলে কালো টাকা এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের এখানে বৈষম্য বেড়েই চলেছে।’ তার মতে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ ‘চূড়ান্তভাবে’ অর্জিত হয়েছে, এটা নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু চিন্তার কারণ হলো গণতন্ত্র নিয়ে, ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে। কারণ যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা টেকসই ভিত্তিতে করা সম্ভব নয়। ‘উদারনৈতিক গণতন্ত্র’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলেও বাংলাদেশে তা ‘দুর্বল’ অবস্থায় রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, দারিদ্র্য নিরসনে এখনো বিশ্বমানের না হওয়ায় গড়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র্যসীমায় রয়েছে। তার মতে, উদার গণতন্ত্র নীতির অভাবে রাজনৈতিক সরকারগুলোর পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ছে দুর্নীতি, যা উসকে দিচ্ছে বৈষম্য। এ অবস্থায় বৈষম্য কমিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে আবারও বাধতে পারে গন্ডগোল। আর এ বৈষম্যকে গুরুত্ব না দিলে আবারও মুক্তিযুদ্ধ হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সত্তর দশকের বাংলাদেশ আজকের আর্থসামাজিক মাপকাঠিতে এগিয়ে গেলেও এর সুফল পাননি পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো। গেল ৫০ বছরে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমলেও তা এখন আন্তর্জাতিক মানে নামেনি। যে চারটি স্তম্ভের ওপর ভর করে স্বাধীন হয়েছিল দেশ তার মধ্যে কেবল জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করা গেলেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি সাম্যনীতি। ফলে কালো টাকা আর দুর্নীতিতে বাড়ছে বৈষম্য। তিনি বলেন, বিজয়ের ৫০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বহুগুণ এগিয়ে গেলেও এখনো গড়ে ৪০-৫০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। আকবর আলি খান বলেন, দেশে উন্নয়ন হচ্ছে, এটা ঠিক। কিন্তু সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বৈষম্য বেড়েছে। সব ক্ষেত্রে সমান উন্নতি হয়নি। উন্নয়ন দিয়ে গণতন্ত্র অর্জন হয় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর গণতন্ত্রে বিশ্বাস নেই। তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে বিশ্বাস করে না।

আকবর আলি খান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারতের অবদান থাকলেও রাষ্ট্র হিসেবে তার প্রতি বাংলাদেশ ‘চিরকৃতজ্ঞ’ থাকতে পারে না। ‘চিরকৃতজ্ঞ’ থাকার কথাটি কিন্তু ১৯৭১ সালে শোনা নয়, এ কথাটা সম্প্রতি উঠেছে। এ রকম চিরন্তন কৃতজ্ঞতাবোধ পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব নয়। এটা জাতির সঙ্গে জাতির বন্ধুত্ব। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব তখনই হবে, যখন আমাদের স্বার্থ অভিন্ন হবে। আর যদি আমাদের স্বার্থের ক্ষেত্রে সংঘাত থাকে, তাহলে চিরন্তন কৃতজ্ঞতা বোধ কোনো দিনই হবে না।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা হয়েছিল। তারা স্পষ্টভাবে বলেছেন, তোমরা স্বাধীনভাবে বাঁচো সেটাই আমরা চাই। তারা কখনো এ কথা কল্পনা করেননি যে বাংলাদেশ কারও কাছে চিরপদানত হয়ে থাকবে। এটা কোনো দিনই সম্ভব নয়।’ আকবর আলি খান বলেন, সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার যে নীতিকে সঙ্গে নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল দেশ, সেখান থেকে অনেক আগেই পেছনে পড়েছে শাসনব্যবস্থা। ফলে উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে না সব শ্রেণির মানুষ। আর এতে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে দরিদ্র মানুষ ৭০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামলেও আন্তর্জাতিক মানদন্ডে তা এখনো ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে।

সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়ন একসঙ্গে হবে না। সুশাসন নিশ্চিত না হলে উন্নয়ন হয় না। উন্নয়নের জন্য সুশাসন প্রয়োজন। আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে আবার অনেক সূচক নিচের দিকেও এসেছে। আমরা পেটপুরে খাবার পাচ্ছি, কিন্তু ৪০ শতাংশ মানুষ এখনো সুপেয় পানি পাচ্ছেন না। তারা কীভাবে খাবার হজম করবেন। উপকূল এলাকাগুলোয় পানির অভাব সবচেয়ে বেশি।’ সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বলেন, ‘৫০ বছরে অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক, সব সূচকেই সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তবে যে রাজনৈতিক চেতনা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম, তা অর্জন করতে পারেনি। চেতনা ভুলে গেছি, এর খেসারত দিতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকে। যতই উন্নয়ন হোক, চেতনা ভুলে গেলে সে উন্নয়ন ধুলোয় মিশে যাবে। মনে রাখা দরকার, উন্নয়ন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখা যাবে না। বরং চেতনা দিয়েই উন্নয়ন ধরে রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ইদানীং ভারত-পাকিস্তানের কিছু লেখক-গবেষক বলছেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নাকি ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ ছিল। ১৩ দিনের যুদ্ধে নাকি দেশ স্বাধীন হয়েছে। এ মিথ্যাচারের জবাব আমাদের লেখক-গবেষকদের থেকে নেই।’ তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হুমকির মুখে। এ চেতনা বিলুপ্ত হলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশ আবার পাকিস্তান হয়ে যাবে। চেতনা কি উদ্?যাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ? বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থাকতে হবে। বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘স্বাধীনতাযুদ্ধে মিত্র হিসেবে ভারত আমাদের পাশে ছিল। এজন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে সে কৃতজ্ঞতা হতে হবে যতটা পাওয়ার কথা ততটুকুই। এর চেয়ে বেশি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ভালো না।’ তিনি বলেন, নিজেদের স্বার্থ সবার আগে দেখতে হবে। স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে যদি কৃতজ্ঞতা দেখাতে হয়, তার প্রয়োজন নেই। এই বীর প্রতীক বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরের রাষ্ট্রের বিশাল অনুষ্ঠানে সেক্টর কমান্ডারদের ডাকা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ কোনো একক ব্যক্তি বা পরিবারের বা দলের ছিল না। এটা ছিল পুরো জাতির যুদ্ধ। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের ডাকা হয়নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে দাবি করা হয়। তিনি এর প্রতিবাদ জানান। মেজর জেনারেল (অব.) হেলাল মোর্শেদ খান বলেন, পাশের দেশের চেয়ে বাংলাদেশ বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। তবে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সুনাম নেই। সরকার গণতন্ত্রের সূচক এগিয়ে নিয়ে যাবে এমনটাই প্রত্যাশা তার। ক্ষমতাসীন সরকারকে ঘায়েল করা বিরোধী দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। সরকার যদি বিএনপির দাবি নিরপেক্ষ সরকার মেনে নেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে যেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা করা না হয়। এর আগে যেমনটা হয়েছিল। এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করতে হবে।

 

সর্বশেষ খবর