শনিবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

লঞ্চে ছিল না আগুন নেভানোর ব্যবস্থা

♦ বিশেষজ্ঞরা বলছেন ত্রুটি ছিল নকশায় ♦ দাহ্য থেকে আগুনের উৎপত্তি

সাখাওয়াত কাওসার

লঞ্চে ছিল না আগুন নেভানোর ব্যবস্থা

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকার পরও লঞ্চের আগুন কেন নেভানো সম্ভব হয়নি, কেনই বা এত প্রাণহানি- এসব প্রশ্ন উঠে আসছে বারবার। কেউ কেউ এমভি অভিযান-১০-এর সার্ভে সার্টিফিকেট নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তবে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ পুরো ঘটনাটি রহস্য আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, নদীতে থাকা লঞ্চে এত সময় ধরে আগুন জ্বলেছে, দগ্ধ মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠলেও তা নেভাতে তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। বিভিন্ন সময় লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ না দেখা এবং বিশেষজ্ঞদের মত বাস্তবায়ন না হওয়াকেও দুষছেন অনেকে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌ-যন্ত্রকৌশল বিভাগের প্রধান ড. এন এম গোলাম জাকারিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে লঞ্চে অতীতেও আগুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে এত ভয়াবহ ঘটনা কখনো ঘটেনি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় সবকিছু তদারকি করা হয়েছিল কি না? অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল কি না? যন্ত্র থাকলেই তো হবে না। সেগুলো কার্যকর ছিল কি না তা-ও দেখতে হবে। একই সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র পরিচালনার জন্য প্রশিক্ষিত লোকজন ছিল কি না লঞ্চে? আবার সর্বশেষ কবে ফায়ার ড্রিল হয়েছে?’

তিনি বলেন, ‘আমি ঘটনাস্থলে যাইনি। তবে টিভিতে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য শুনেছি। অবশ্য সবকিছু নিয়েই গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত করবে। প্রকৃত কারণ বের হয়ে আসবে। আসলে প্রতিটি লঞ্চের ডিজাইনেই সবকিছু পরিষ্কার করা থাকে। সিঁড়ি কতটুকু খাড়া হবে, প্রতিটি ডেকে বহির্গমন দরজা থাকবে কতগুলো- লঞ্চের ফিটনেস দেওয়ার আগে বাস্তবে এগুলোর সত্যতা যাচাই নিশ্চিত হয়েই করার কথা কর্তৃপক্ষের।’

অতীতের বিভিন্ন দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন বাস্তবায়ন না করলে তদন্ত করিয়ে লাভ কী? যারা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা উচিত। তিনি যে পর্যায়ের লোকই হোন না কেন। অন্যদিকে শুধু বিধিমালায় রাখলে হবে না। এর বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে দরকার নিয়মিত তদারকি।’ মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা নিয়ে কথা হয় বুয়েটের একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জুবায়ের ইবনে আওয়ালের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি নিজে ঘটনাস্থলে যাইনি। তবে টিভিতে যা দেখেছি হৃদয়বিদারক। আমার কাছে ঘটনাটি রহস্য মনে হয়েছে। কারণ এত সময় ধরে আগুন জ্বলল কিন্তু তা নেভানো সম্ভব হলো না কেন? অথচ মানুষ আগুনের ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিয়েছে। অতীতেও যে নৌপথে আগুনের ঘটনা ঘটেনি, তা নয়। কিন্তু সেগুলো নেভি বা কোস্টগার্ডের সদস্যরা অল্প সময়ের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছিলেন। লঞ্চের স্টিল তো এভাবে পোড়ার কথা নয়। তাহলে কেন এত পুড়ল? লঞ্চের বডি কেমন ছিল, তা ব্যবহার-উপযোগী কি না গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘ফায়ার ট্রায়াঙ্গেলের উপস্থিতি না থাকলে আগুন লাগা অসম্ভব। হয়তো ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল, নয় ধূমপানের কারণে কিংবা শীতের তীব্রতা থেকে উপশম নিতে কেউ আগুন ধরিয়েছিল। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে স্পার্কিং, অক্সিজেন এবং দাহ্য পদার্থের নিশ্চিত উপস্থিতি না থাকলে আগুন ধরবে না। অনেকেই বলছেন ইঞ্জিনে নাকি সমস্যা ছিল। আরেকটা বিষয় হলো, আগুনের ঘটনা ঘটলেও অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রের সাহায্যে ক্রুদের তা দ্রুত নিভিয়ে ফেলার কথা। তবে প্রশ্ন হলো, তারা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলেন কেন? ক্রুরা প্রশিক্ষিত ছিলেন কি না? লঞ্চের পেইন্ট কেমন ছিল? অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রগুলো কাজ করেছে কি না, আবার বহির্গমন দরজা কি পর্যাপ্ত ছিল?’ তদন্তে কমিটিতে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পেশাদারদের দিয়ে তদন্ত করানো উচিত। সত্যিকারের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে উঠে আসা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। সেইফটি প্রটেকশন নিশ্চিত না করে কোনো যানবাহনকেই নামতে অনুমতি না দেওয়ার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্তে আসতে হবে। লঞ্চের সার্ভে সার্টিফিকেট সঠিক ছিল কি না, না থাকলে জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

কাগজে কলমেই সুপারিশ : বুড়িগঙ্গা নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পেছনে নয়টি কারণ চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে ২০ দফা সুপারিশ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। গত বছর ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় দুই লঞ্চের সংঘর্ষে ৩৪ জনের লাশ উদ্ধার হয়। এ ঘটনার তদন্তে গঠিত কমিটির সুপারিশ কাগজে কলমেই রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (উন্নয়ন) মো. রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক ও বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) মো. রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে গঠিত সাত সদস্যের ওই কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ হিসেবে ঢাকা সদরঘাটের কাছে নৌযানের বার্থিং বন্ধ করা, খেয়াঘাট সরিয়ে নেওয়া, ভয়েস ডিক্লারেশন বাধ্যতামূলক করা, নৌযানের গতিসীমা নির্ধারণ, পুরনো ধাঁচের লঞ্চ তুলে দেওয়া, লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি বন্ধ করা এবং শাস্তি বাড়িয়ে নৌ আইন যুগোপযোগী করার বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর