রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

গণকবর আহাজারি আর্তনাদ

♦ ২১ কবরে দাফন ২৩ জনকে ♦ থানায় অপমৃত্যু মামলা ♦ ঘটনাস্থলে তিন তদন্ত কমিটির সদস্যরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল এবং ঝালকাঠি ও বরগুনা প্রতিনিধি

গণকবর আহাজারি আর্তনাদ

ঝালকাঠিতে লঞ্চে আগুনে মৃত ২৩ জনকে বরগুনার পোটকাখালীতে গণকবর দেওয়া হয় -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সারিবদ্ধ ২৩টি কফিন, ভিতরে পোড়া লাশ। পাশে স্বজনহারা মানুষের বুকফাটা আহাজারি; করুণ আর্তনাদ। শোকাবহ পরিবেশে গণজানাজা হলো ২৩ জনের। নিদারুণ করুণ কণ্ঠে স্থানীয় কালেক্টরেট জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা জাহিদুল ইসলাম সবার জন্য দোয়া করেন। এ সময় আকুল কান্নায় যেন ভারী হয়ে ওঠে বরগুনার আকাশ-বাতাস। গতকাল বেলা সোয়া ১১টায় সার্কিট হাউস মাঠে জানাজা শেষে লাশগুলো নেওয়া হয় ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামে। সেখানে ২১টি কবরে দাফন করা হয় ২৩টি লাশ। লাশগুলো এতই  পোড়া ছিল যে কোনটা নারী আর কোনটা পুরুষ, কে হিন্দু কে মুসলমান কিছুই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

নিখোঁজ বহু মানুষের স্বজন সেই জানাজায় অংশ নেন। তারাও জানতে পারেননি হয়তোবা তারই স্বজনের জানাজা পড়ছেন। দাফন করা লাশগুলো শনাক্তে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। এদিকে লঞ্চডুবির ঘটনায় ঝালকাঠি সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। গতকাল ঝালকাঠি সদর উপজেলার দিয়াকুল এলাকার গ্রামপুলিশ জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এ ছাড়া ঘটনাস্থল ও পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেছে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি।

বরগুনা সার্কিট হাউস মাঠে গণজানাজায় অংশ নেন বরগুনা সদর উপজেলার ধলুয়া ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের কনু হাওলাদার। কুকফাটা আহাজারি করে তনু হাওলাদার বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা ছেলে, ছেলের বউ, নাতনি ও ছেলের শাশুড়ি এ লঞ্চের যাত্রী ছিল। তাদের কোনো খোঁজ পাইনি। হয়তো আমি তাদেরই জানাজা পড়লাম।’ এই বলে মূর্ছা যান তনু হাওলাদার।

বৃহস্পতিবার ভোররাতে ঝালকাঠির গাবখানের কাছাকাছি পোনাবালিয়া ইউনিয়নের দেউরী এলাকায় সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন ধরে। লঞ্চটি ঢাকা-বেতাগী-বরগুনা রুটে যাতায়াত করত। আগুন লাগার পর ঝালকাঠি সদর উপজেলার ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের দিয়াকুলের তীরে ভেড়ানো হয় লঞ্চটি। ওই আগুনে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যারা প্রাণে বাঁচেন তারা রাতের আঁধারে নিজেরাই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অনেকে পানিতে ডুবে মারা গেছেন; কেউ আবার দাউ দাউ আগুনে লঞ্চেই দগ্ধ হয়েছেন।

বরগুনা জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, জেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামে গণকবরে ২৩টি লাশ দাফন করা হয়েছে। তার আগে শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টায় ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন ৩৭টি মৃতদেহ বরগুনা জেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিকে হস্তান্তর করে।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, লঞ্চ থেকে যেসব লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তার অধিকাংশই শনাক্ত করার মতো অবস্থায় ছিল না, তাই ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। কারও ডিএনএর সঙ্গে মিলে গেলে সে অনুযায়ী কবর দেখিয়ে দেওয়া হবে। জেলা প্রশাসন যে লাশগুলো দাফন করেছে সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলম বলেন, শুক্রবারই ঝালকাঠি থেকে চারজনের ও বরিশাল শেরেবাংলা হাসপাতাল থেকে একজনের মৃতদেহ স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া বরিশাল, ঝালকাঠি ও বরগুনা থেকে ১০ জনকে শনাক্ত করে স্বজনরা নিয়ে গেছেন। এদিকে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বার্ন ইউনিটে একজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, যারা শনাক্ত করে মৃতদেহ নিয়ে গেছেন তাদের দাফনের জন্য প্রত্যেককে নগদ ২৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে আহত দগ্ধদের বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। হাসপাতালসূত্র জানান, শুক্রবার ভোর ৬টা থেকে গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত লঞ্চে দগ্ধ ৮১ জনকে শেরেবাংলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে গুরুতর ১৯ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে একটি শিশুকে ঢাকায় পাঠানোর সময় মারা যায়। গত ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয়ে ১৬ জন বাড়ি ফিরে গেছেন।

গতকাল শেবাচিমে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪৬ জন দগ্ধ। তার মধ্যে আশঙ্কাজনক তিনজন আইসিইউতে, হাত-পা ভেঙে যাওয়া পাঁচজন অর্থোপেডিক্সে, পাঁচ শিশুসহ ৩৮ জন সার্জারি বিভাগের অধীনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম জানান, লঞ্চে দগ্ধদের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে পাঁচজন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে দুজন চিকিৎসক বরিশাল এসেছেন। তারা চিকিৎসাসেবা শুরু করেছেন। তাদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা আসায় দগ্ধদের উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে তিনি জানান।

নিখোঁজ ২৬ : ঝালকাঠি জেলা প্রশাসনসূত্র জানিয়েছেন, তাদের করা তালিকা অনুযায়ী আগুনের ঘটনায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ২৬ যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল দিনভর নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করেও নতুন লাশের সন্ধান মেলেনি। ফায়ার সার্ভিস ও কোস্টগার্ডের ডুবুরি দল নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারে সকাল থেকে দিনভর সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে অভিযান চালায়। কিন্তু সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো লাশ উদ্ধার করতে পারেনি। এ সময় স্বজনরাও ট্রলার নিয়ে নিখোঁজ যাত্রীদের নদীতে খুঁজে বেড়িয়েছেন।

ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি : গতকাল সকালে জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কমিটির প্রধান নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব তোফায়েল আহমেদ এবং সদস্য ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক কামাল উদ্দীন ভূঁইয়া, বরিশাল নৌপুলিশ সুপার কফিল উদ্দীন, ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আলম, নৌপরিবহন (ইঞ্জিনিয়ার) তাইফুর আহমেদ ভূঁইয়া, মোংলা নৌ-চলাচল বন্দরের মামুন অর রশিদ ও বিআইডব্লিউটিএ প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেন।

কমিটির প্রধান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চে বিআইডব্লিউটিএ যে-সংখ্যক যাত্রীর কথা বলেছে এর চেয়ে যাত্রী অনেক বেশি ছিল। কারণ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এমনিতেই লঞ্চে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী থাকে।

গতকাল সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটি পদির্শন করেন। এ সময় তিনি বলেন, এ ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্তে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

উদ্ধারকাজে নেতৃত্বদানকারী বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক মো. বেলাল উদ্দীন জানান, নিখোঁজ যাত্রীদের উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

বরিশালে বিক্ষোভ : লঞ্চে দগ্ধদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে বার্ন ইউনিট চালুর দাবিতে বরিশালে বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। গতকাল বেলা ১১টায় মহানগরের সদর রোডে অশ্বিনী কুমার হলের সামনে এ বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।

জেলা বাসদ আহ্বায়ক ইমরান হাবিব রুমনের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন সদস্যসচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী, ছাত্রফ্রন্ট নেতা বিজন সিকদার, সাগর দাস আকাশ, লামিয়া সায়মন, জোহরা রেখা ও শহিদুল ইসলাম।

বড়দিনের আয়োজন সংক্ষিপ্ত : দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বরগুনার বেতাগীতে একমাত্র খ্রিস্টানপাড়ায় বড়দিনের উৎসবেও শোকের ছায়া পড়েছে। ঢাকা-বতাগী-বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ আগুনে নিহতদের স্মরণে উৎসব সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। শোকের আবহে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে বড়দিন পালিত হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর