রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

স্বজনরা চিনতে পারছেন না দগ্ধদের

ঢাকার বার্ন ইনস্টিটিউটে আশঙ্কাজনক ১৫ জন, বরিশালে ৪৬

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা ও বরিশাল

স্বজনরা চিনতে পারছেন না দগ্ধদের

লঞ্চের আগুনে দগ্ধদের মধ্যে কারও শ্বাসনালিসহ মুখমন্ডল পুড়েছে। কারও পুড়েছে পায়ের তালু। অনেকের হাত-পা ভেঙে গেছে। অনেককে চেনা যাচ্ছে না। স্বজনরাও প্রিয়জনদের চেনারূপে না পেয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। কাউকে নেওয়া হয়েছে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। পোড়া শরীরের যন্ত্রণা আর স্বজনদের কান্নায় ঢাকা, বরিশাল, ঝালকাঠি ও বরগুনা হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় যাদের রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে তাদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তাদের সবারই শ্বাসনালি দগ্ধ হয়েছে। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৪৬ জন। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক তিনজন আইসিইউতে, হাত-পা ভেঙে যাওয়া পাঁচজন অর্থোপেডিক্সে এবং পাঁচ শিশুসহ ৩৮ জন সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গতকাল সকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বার্নে ভর্তি রয়েছেন ১৫ জন, যাদের কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তার মধ্যে দুজন আইসিইউতে। আমাদের সাতজনের একটি টিম বরিশালে গেছে। শুক্রবার রাত দেড়টা পর্যন্ত তারা রোগী দেখেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল সকাল থেকেই তারা রোগী দেখেছেন। যদি কোনো রোগীকে ঢাকায় আনার প্রয়োজন হয় আমরা নিয়ে আসব। না হলে তাদের সেখানেই চিকিৎসা দেওয়া হবে।’

ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘আমি বারবারই বলি যতক্ষণ সচেতনতা না আসবে ও মনিটরিং না করা হবে ততক্ষণ এ ধরনের দুর্ঘটনা কেউ ঠেকাতে পারবে না।’ বার্ন ইনস্টিটিউটে সরেজমিনে দেখা গেছে, ওয়ার্ডের বাইরে পোড়া রোগীদের কয়েকজন অঝরে কাঁদছেন। ভাতিজি লামিয়ার মাকে খোঁজার আকুল আবেদনে বারবার চোখে পানি চলে আসছিল আল আমিনের। লামিয়া তাকে বলছিল, ‘কাকা আমার মা কোথায়। মা তো আমাদের সঙ্গে লঞ্চে ছিল। মাকে দেখছি না কেন? আমার মাকে এনে দাও।’ দগ্ধ অবস্থায় বার্ন ইনস্টিটিউটের পোস্ট অপারেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন লামিয়া অনেক কষ্ট করে ধীরে ধীরে তার কাকা আল আমিনের কাছে মায়ের খোঁজ নিচ্ছিল। ভাতিজিকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আল আমিন বলেন, ‘তোমার মা লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি ভালো আছেন, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন। দ্রুত সুস্থ হয়ে তোমাকে দেখতে আসবেন।’ আল আমিন বলেন, ‘আমি কীভাবে আমার ভাতিজিকে বলব তার মা ও ছয় বছরের ছোট বোন লঞ্চে আগুন লাগার পর থেকে নিখোঁজ।’

ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে আল আমিনের মা মমতাজ বেগম (৭৫) ও বড় ভাই ইসমাইল তার স্ত্রী কল্পনা (৪৫) এবং দুই মেয়ে লামিয়া (১৪) ও নুসরাতকে (৬) নিয়ে যাচ্ছিলেন। লঞ্চে অগ্নিকান্ডের পর থেকে কল্পনা ও নুসরাত নিখোঁজ। লামিয়া (১৪) ও মমতাজ বেগম বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন।

বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানান, অগ্নিদগ্ধ ২১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছিল। তার মধ্যে ১৬ জনকে ভর্তি নেওয়া হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে চারজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজন মারা গেছেন। ১২ জনকে পোস্ট-অপারেটিভ ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। একজনকে পিএইচডিউতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, লঞ্চের আগুনে দগ্ধ আরও ৩২ জন বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তাদের যে দলটি সেখানে গেছে তারা প্রয়োজনীয় কিছু চিকিৎসা সরঞ্জামও নিয়ে গেছে। এদিকে বার্ন ইনস্টিটিউটের জরুরি বিভাগের আবাসিক চিকিৎসক ডা. এস এম আইউব হোসেন জানান, দগ্ধ ১৫ জনকে এখানে ভর্তি রাখা হয়েছে। আর বিকাশ মজুমদার (১৬) নামে একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বাকিদের চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মিলন (৩৮) নামে আরও একজন ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার পিঠের হাড় ভেঙে গেছে।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার পথে ছেড়ে যায় এম?ভি অভিযান-১০ লঞ্চ। রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর গাবখান ধানসিঁড়ি এলাকায় লঞ্চটিতে আগুন লাগে। এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। যুগ্মসচিব তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। পরে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন। আর বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সাইফুল ইসলামকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বিআইডব্লিউটিএ।

গতকাল দুপুরে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে রোগীদের সার্বিক খোঁজখবর নিতে যান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ অগ্নিকান্ডে আহত ৮১ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৬ জনের চিকিৎসা চলছে। ১৬ জনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আহতের মধ্যে ৩২ জনের চিকিৎসা চলছে বরিশালে। সাত সদস্যের চিকিৎসক টিম পাঠানো হয়েছে। তারা সেখানে চিকিৎসা দিচ্ছেন। আমরা মনিটরিং করছি। আহতদের সব ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাসপাতালের পক্ষ থেকে চিকিৎসার খরচ বহন করা হচ্ছে। নিহতদের লাশ বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থাও হাসপাতালের পক্ষ থেকে করা হবে।’

এদিকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধদের সেবায় একটি কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক। সেখানে চিকিৎসাধীন রোগীদের রয়েছে নানা অভিযোগ। প্রয়োজনের সময় ডাক্তার ডেকে না পাওয়ার অভিযোগ বেশির ভাগের। তবে ঢাকা থেকে যাওয়া সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিমের সেবায় সন্তুষ্ট তারা।

ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের প্রধান ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্র্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুরুল আলম বলেন, ‘শেবাচিমে চিকিৎসাধীন পাঁচজনের শ্বাসনালিসহ মুখমন্ডল পুড়ে গেছে। তাদের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া চিকিৎসাধীন বেশির ভাগের মুখমন্ডল এবং হাত ও পায়ের তালু পুড়ে গেছে। অনেকের হাত-পা ভেঙে গেছে। তাদের যথাযথ চিকিৎসা চলছে। যাদের এখানে অপারেশন সম্ভব তাদের এখানেই অপারেশন করা হবে, অন্যদের পাঠানো হবে ঢাকায়।’ দগ্ধদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতে শেবাচিম হাসপাতালে একটি কন্ট্রোল রুম চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম। সুচিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের অভাব-অভিযোগ পূরণে কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

ঝালকাঠিতে লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গতকাল সকাল পর্যন্ত ৩৮ জনের মৃত্যুর কথা জনিয়েছেন ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী।

সর্বশেষ খবর