মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

অস্তিত্ব হারাচ্ছে ২০-দলীয় জোট

শফিউল আলম দোলন

অস্তিত্ব হারাচ্ছে ২০-দলীয় জোট

অস্তিত্ব হারাতে চলেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোট ও ফ্রন্টের ব্যানারে এখন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না। কোনো কার্যক্রমও নেই তাদের। রাজনীতির ময়দানে নামেমাত্র ধরে রাখা অস্তিত্বটুকুও হারাতে বসেছে দেশের বৃহৎ এই বিরোধীদলীয় জোট। জোটের নেতৃত্বে থাকা প্রধান দল বিএনপির অবমূল্যায়ন, অবহেলা ও অবমাননায় এতদিন শরিকরা সংক্ষুব্ধ থাকলেও এখন তারা এ বিষয় একেবারেই নীরব। বিএনপির ‘একলা চলো নীতি’র কাছে শরিক দলগুলোর আগ্রহ ও উৎসাহে একেবারেই ভাটা পড়েছে। হতাশার কবলে পড়ে তারা নিজেদের মধ্যে সাংগঠনিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় তুঙ্গে রয়েছে জামায়াত-বিএনপির টানাপোড়েন।

বিএনপির নেতৃত্বে ১৯৯৯ সালে গঠিত চারদলীয় জোট সম্প্রসারণ ঘটিয়ে ২০১২ সালে ১৮-দলীয় জোট এবং পরে আরও দুটি দল নিয়ে ২০-দলীয় জোট গঠিত হয়। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে এ জোট গঠন করা হয়েছিল, এ মুহূর্তে তা আর কার্যকর করা সম্ভব হবে না বলে মনে করছে বিএনপি। কারণ এই জোটের প্রত্যেকটি শরিক দলই এখন ভাঙনের মুখে পড়ে দুর্বল হয়ে গেছে। এর আগে জোটে থেকেও কোনো কোনো শরিক দলের মূল নেতা বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতিও দিয়েছেন। এমনকি জোটের ভিতর উপজোট গঠনের চেষ্টাও করেছেন। অথচ এদের মধ্যে অনেক দলের সাংগঠনিক ভিত্তিও একেবারে নেই বললেই চলে। জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্য দল ও নেতা হিসেবে প্রায় গুরুত্বহীন তারা। এ ধরনের নামসর্বস্ব দলগুলোকে মোটামুটি সক্রিয় ডান-বাম ও ইসলামী দলগুলোকে এক কাতারে এনে নতুন জোটের প্রক্রিয়া করছে বিএনপি।

২০-দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস (একাংশ), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি-জাগপা, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ন্যাপ, মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম (একাংশ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এডিপি, ইসলামিক পার্টি, ডেমোক্রেটিক লীগ, পিপলস লীগ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), সাম্যবাদী দল এবং জাতীয় দল। বিএনপি ছাড়া এ জোটের প্রায় প্রতিটি দলই দ্বিখন্ডিত হয়েছে। ২০-দলীয় জোটের মধ্যে নিবন্ধিত দল মাত্র ছয়টি, বাকি দলগুলো অনিবন্ধিত।

অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত দলগুলো হচ্ছে- বিএনপি, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ। এগুলোর মধ্যে গণফোরাম ও জেএসডি ভাঙনের মুখে পড়েছে। ড. কামালের নেতৃত্বে গণফোরামের ঐক্য অটুট রাখার জোর প্রচেষ্টাও কোনো কাজে লাগেনি।

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০-দলীয় জোট ইতিমধ্যে কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। তবে কৌশলগত কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে এই জোট বিলুপ্তির ঘোষণা দিতে চায় না বিএনপি। আগামী দিনে দলের একক কর্মকৌশলের মাধ্যমেই তা পরিষ্কার হবে। জোটের শরিকরাও যার যার মতো করে নিজেদের অবস্থান বা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। একইভাবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও বিগত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে প্রায় তিন বছর ধরে নিষ্ক্রিয়। পেশাজীবী নেতাদের সঙ্গে গেল অক্টোবরে মতবিনিময়ের পর দলের মাঠপর্যায়ের নেতা ও পেশাজীবীদের মতামতের সারমর্ম লিপিবদ্ধ করেছে বিএনপি হাইকমান্ড। পরবর্তীতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে পর্যালোচনা শেষে সম্মিলিত বিরোধী জোট গঠনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগোচ্ছে দলটি। নতুন আঙ্গিকে আরেকটি বৃহত্তর জোট গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের। সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, জাতীয় নির্বাচন ও পরবর্তীতে সরকার গঠনের যাবতীয় ছক নিয়েই গঠিত হবে এই রাজনৈতিক জোট। নতুন জোটের সম্ভাব্য নাম হলো- ‘সম্মিলিত বিরোধীদলীয় জোট’। তবে সাংগঠনিকভাবে মোটামুটি শক্তিশালী ও সক্রিয় ডান, বামসহ ইসলামী নানা সংগঠন থাকলেও জামায়াতে ইসলামী থাকছে না বলেই ইঙ্গিত দিয়েছেন দলের একাধিক নীতিনির্ধারক। অনেকটা কৌশলে বাইরে রাখা হচ্ছে জামায়াতকে। এ ছাড়া ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য দলগুলোও এতে থাকবে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা সমমনা সব রাজনৈতিক দল ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে চাই। পাশাপাশি নিজেদের দল গোছাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশে একনায়কতান্ত্রিক শাসন হঠিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আগামী দিনে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের শক্তিগুলোর সঙ্গে সে লক্ষ্যে যোগাযোগ করছি আমরা। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জোট এখন কার্যকরও না, আবার অকার্যকরও না। আমার এতটা বছরের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি নিজেও বুঝি না যে, বিএনপি কী চায়? তারা কোন পথে যেতে চায়? তারা জোটের নিবন্ধিত দলগুলোকে বাদ দিয়ে সেসব দল থেকে বহিষ্কৃত নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। ঠিকানাবিহীন নেতা ও দলের অনুষ্ঠানে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। ২০-দলীয় জোট যদি বিএনপি না-ই রাখতে চায়- তাহলে পরিষ্কার করে বলে দিলেই পারে যে, জোট আজকে থেকে বিলুপ্ত! মুখে এক কথা, আর কাজে আরেক কথা। এটা তো কোনো ইমানদারের কাজ হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে। নিবন্ধিত দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এই অবস্থায় অন্তত জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে বসে বিএনপির এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এখন কার্যত নিষ্ক্রিয়। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা-ও এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। তাছাড়া ফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন সাহেবও এখন বয়সের ভারে আক্রান্ত। ফলে এটিকে সচল করারও আর সম্ভাবনা নেই। তবে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সবার ঐক্য জরুরি। এ দাবি আদায়ে নতুন এক মঞ্চেও আন্দোলন হতে পারে, আবার যুগপৎ আন্দোলনও হতে পারে। জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রায় দুই বছর ধরেই এই জোট নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এটাকে আর সচল বলা যাবে না। এই জোটের সৃষ্টি হয়েছিল বিএনপির আহ্বানে। কাজেই জোটকে সচল করতে হলে বিএনপিকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জোটের পক্ষ থেকে কোনো কার্যক্রম এখন না থাকলেও বিএনপি চেয়ারপারসনের মুক্তি ও তাঁকে বিদেশে পাঠানোর দাবিতে আমরা আলাদাভাবে নিজেদের উদ্যোগে কর্মসূচি পালন করছি। কিন্তু জোটের শরিক দল হিসেবে বিএনপির সঙ্গে একেবারেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমি মনে করি, চালকের আসনে থাকা বিএনপিকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

সর্বশেষ খবর