মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

আইনের মতামত স্বরাষ্ট্রে, বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে চিকিৎসার সুপারিশ গোয়েন্দা সংস্থার

উবায়দুল্লাহ বাদল

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে মতামত দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। কী মতামত দিয়েছেন সে বিষয়ে কিছুই জানাননি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তবে তিনি আভাস দিয়ে বলেছেন, যে আবেদনে তাঁর (খালেদা) বাসায় চিকিৎসার সুযোগ হয়েছে তা আবারও বিবেচনার সুযোগ নেই। আইনি মতামতটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে এখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবে। মূলত সেখান থেকেই আসবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এমন আভাসই মিলেছে। তারা বলেছেন, দন্ডপ্রাপ্ত খালেদা এখন কারাগারের অংশ। তাকে দেশের বাইরে নিতে হলে অবশ্যই আদালতের নির্দেশনার প্রয়োজন হবে।

এর আগে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার সুপারিশ ছিল-খালেদা জিয়াকে আইনানুগভাবে চিকিৎসার প্রয়োজনে দেশের বাইরে পাঠানোর  কোনো সুযোগ রয়েছে কি না, তা বিচার                 বিশ্লেষণ করতে দেশের স্বনামধন্য আইনজীবীদের সমন্বয়ে বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করা যেতে পারে। পাশাপাশি খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিতকল্পে দেশের স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল র্বোড গঠন করা যেতে পারে। এমনকি বিশেষ প্রয়োজনে দেশের বাইরে থেকে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এনে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এসব সুপারিশও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য তার ভাই আবারও যে আবেদন করেছেন, সেই আবেদনের ব্যাপারে আমাদের আইনি মতামত দিয়ে আমরা এটি এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা জানেন যে, এর আগেও যতবারই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ফাইলটা গেছে। যেহেতু এটা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ফাইলটা যাবে আমার যে মতামত সেটা কিন্তু এখন আপনাদের বলতে পারব না, এটার গোপনীয়তা রাখতে আমি বাধ্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জানিয়ে দিয়েছি ফাইলটি ওনার কাছে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইল যাওয়ার পর আপনারা সিদ্ধান্ত জানতে পারবেন।’ আইনমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি কিন্তু বারবারই একটি কথা বলেছি, ৪০১ ধারায় যে ছয়টি উপধারা আছে, সেখানে পাস্ট অ্যান্ড ক্লোজ ট্রানজেকশনে (ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় যে দরখাস্ত একবার নিষ্পত্তি হয়, সেই দরখাস্তকে আবার পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ না থাকা) আবার বিবেচনা করার কিন্তু কোনো সুযোগ নেই।’ ৪০১ ধারা নিয়ে আপনার আগের মতামতের ওপর স্থির (স্ট্যান্ড) আছেন কি না- জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘স্ট্যান্ড আর সিটিংয়ের কোনো ব্যাপার না এটা, আইনের যে ব্যাখ্যা, আমি আইনের যে ব্যাখ্যা দিয়েছি, সে ব্যাখ্যার সঙ্গে কোনোখানেই আমি দেখিনি তার জাজমেন্টে দ্বিমত আছে। আমার ব্যাখ্যাটাই আমি সঠিক বলে মনে করি।’ এর আগে এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘যেহেতু খালেদা জিয়া দন্ডপ্রাপ্ত, তাই তিনি কারাগারের অংশ। সেখান থেকে বের করতে হলে কোর্টের নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা যেটা করেছি তা হলো-তার পরিবারের পক্ষ থেকে মানবিক আবেদন করেছিল। মানবতার মা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী আদেশে দন্ড স্থগিত করে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। এটা একবার করা হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয়বার করতে হলে তাকে আবারও কোর্টে যেতে হবে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসা হোক আর অন্য কারণেই হোক খালেদা জিয়াকে দেশের বাইরে নিতে হলে আদালতের আদেশ থাকতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তবে যেহেতু তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী, একটি বড় রাজনৈতিক দলের নেতা, তাই সরকারপ্রধান চাইলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। সেটিও হতে হবে আদালতের মাধ্যমে। তার অসুস্থতার বিষয়ে সরকার কর্তৃক গঠিত মেডিকেল বোর্ড কোনো সুপারিশ করলে সেটি সরকার আমলে নিয়ে আদালতে যেতে পারে। তারপরই শুধু এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সরকারপ্রধানের ইচ্ছার ওপর। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদন্ড দেয় বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ আদালত। রায় ঘোষণার পর খালেদাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী রাখা হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর এই মামলায় আপিলে তার আরও পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করে হাই কোর্ট। একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ডের আদেশ দেয় একই আদালত। রায়ে সাত বছরের কারাদন্ড ছাড়াও খালেদা জিয়াকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদন্ডের আদেশ দেন। গত বছরের মার্চে করোনা মহামারী শুরু হলে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী আদেশে দন্ড স্থগিত করে কারাবন্দী খালেদাকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয় সরকার। মুক্তির মেয়াদ শেষ হলে গত বছরের ২৫ আগস্ট বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে স্থায়ী মুক্তি চেয়ে আবেদন করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কয়েক দফায় তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ায়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আথ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, দাঁত ও চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। গত ১৩ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তিনি লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। তার পরিপাকতন্ত্রে একাধিকবার রক্তক্ষরণ হয়েছে। খালেদা জিয়া হাসপাতালটির ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তার চিকিৎসার জন্য গঠিত হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ড অবিলম্বে তাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করেছে বলে জানানো হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে পরিবারের পক্ষ থেকে তার ভাই শামীম এস্কান্দার খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার আবেদন করেন। কিন্তু সরকার সেই অনুমতি দেয়নি।

 বিদেশে যাওয়া যাবে না এবং বাড়িতে বসে চিকিৎসা নিতে হবে- আগের মতো এই দুটি শর্তে গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে তার দন্ড স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেয়। এরপরও শামীম এস্কান্দার বেগম জিয়াকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সরকারের কাছে ফের আবেদন করেন।

সর্বশেষ খবর