বৃহস্পতিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বিএনপির সমাবেশ ছয় জেলায়, ১৪৪ ধারা ফেনীতে, বোমা বিস্ফোরণ

♦ খালেদার শারীরিক অবস্থার অবনতি : চিকিৎসক ♦ বিদেশ নিতে ফের জেলে যেতে হবে : আইনমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিএনপির সমাবেশ ছয় জেলায়, ১৪৪ ধারা ফেনীতে, বোমা বিস্ফোরণ

নরসিংদীতে বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী – বাংলাদেশ প্রতিদিন

জেলা বিএনপির সমাবেশে দলীয় নেতারা বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার্থে বিদেশে যেতে না দিলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে অংশ নিতে হবে।

এদিকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আজ মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় গতকাল অনুষ্ঠিত বিএনপির সমাবেশ সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো বিবরণ-

নরসিংদী : বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, আওয়ামী লীগ সংবিধান স্বীকৃত জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়ে, দেশের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছে। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে তাঁর নেতৃত্বে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। গতকাল দুপুরে নরসিংদী জেলা বিএনপির সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনের সভাপতিত্বে এতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা বক্তব্য রাখেন।

ফেনী : জেলা বিএনপির সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল গতকাল। কিন্তু ফেনী সদরে সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন। শহরের ওয়াপদা মাঠে জেলা বিএনপি ও জেলা যুবলীগ পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকায় ওই স্থানসহ সব পৌর এলাকায় মঙ্গলবার রাতেই ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা প্রশাসক। সকালে শহরের ইসলামপুর রোড থেকে বিএনপি বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশ বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে বিএনপি নেতারা তাকিয়া রোডস্থ ফেনীর পাগলা বাবার মাজারের সামনে সংক্ষিপ্ত সভার আয়োজন করেন। এতে বেগম খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা ও ফেনী-২ আসনের সাবেক এমপি জয়নাল আবেদিন (ভিপি জয়নাল), কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা রফিকুল আলম মজনু, বেলাল হোসেনসহ জেলা বিএনপির নেতারা বক্তব্য রাখেন।

এদিকে গতকাল পুরো রাত ফেনী শহরের ট্রাংক রোডসহ বিভিন্ন অলিগলিতে ব্যাপক সংখ্যক ককটেল ও বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। রাত ১২টার পর শহরের ট্রাংক রোডে অবস্থান নেয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। 

ফেনীর জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান জানান, ওই স্থানে ২৮ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ করার কথা ছিল। অনিবার্য কারণবশত তা স্থগিত করা হয়। বুধবার ২৯ ডিসেম্বর একই স্থানে সমাবেশ করতে বিএনপি একটি আবেদন পুলিশ বিভাগে প্রেরণ করে। কিন্তু একই স্থানে পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ডাকায় পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে তিনি ঘটনাস্থলে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেন।   

ঝিনাইদহ : ঝিনাইদহ শহরের উজির আলী স্কুল মাঠে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক মন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে জেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাডভোকেট মশিয়ূর রহমানের সভাপতিত্বে সাবেক হুইপ ও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মসিউর রহমান, খুলনা বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, সাবেক এমপি মসিউর রহমান, সাবেক এমপি শহিদুজ্জামান বেল্টু, সাবেক এমপি আবদুল ওহাব প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

নোয়াখালী : নোয়াখালীতে জেলা বিএনপির সমাবেশে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক অভিযোগ করে বলেন, রাষ্ট্রপতি যদি চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীকে মাফ করে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে পারেন, তাহলে স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া কেন চিকিৎসার অভাব বোধ করবেন। খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে রাষ্ট্রপতিকে তাঁর ক্ষমতা ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, না হয় দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং চিকিৎসার জন্য প্রাণ দেবে। এ সময় দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি খালেদা জিয়ার মুক্তি ও চিকিৎসার দাবিতে প্রয়োজনে প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকারও নির্দেশ দেন তিনি। দুপুরে বেগমগঞ্জ উপজেলার অনন্তপুরে খোলা মাঠে জেলা বিএনপির সভাপতি গোলম হায়দার বিএসসির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুর রহমান, কাজী মফিজুর রহমান প্রমুখ।

ভোলা : জেলা বিএনপির সমাবেশে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম বলেছেন, বিএনপি সরকার কায়েম করে খালেদা জিয়াকে বিদেশ পাঠানো হবে। তিনি বলেন, অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই সরকারের পতন ইনশাআল্লাহ আপনারা দেখতে পাবেন। জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীরের সভাপতিত্বে জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার।

ঠাকুরগাঁও : ঠাকুরগাঁওয়ে অনুমতি চেয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের জনসভার প্যান্ডেল তৈরি শুরু করলে এতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। খালেদা জিয়ার  মুক্তি ও সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণের দাবিতে জেলা পর্যায়ে সমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ২টায় শহরের কালীবাড়ী পাবলিক ক্লাব মাঠে এই জনসভার আয়োজন করেছিল বিএনপি। জনসভায় প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। মঙ্গলবার বিকালে জনসভার নির্ধারিত স্থানে মঞ্চ তৈরির কাজ শুরু হলে তা কাজ বন্ধ করে দেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার রহমান।

খালেদা জিয়ার শারীরিক  অবস্থার অবনতি : এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। গত দুই দিন ধরে তাঁর পরিপাকতন্ত্রে ফের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে যে কোনো সময় তাঁর বড় বিপদ হতে পারে। জানা গেছে, কয়েক দিন ধরে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। দুই দিন ধরে অনবরত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে না কোনোভাবেই। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। খনিজের অসমতা দেখা দিচ্ছে। তাই শরীর খুবই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যেই বমি হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে উন্নত চিকিৎসার্থে তাঁকে বিদেশে না নিলে ‘মৃত্যুঝুঁকি’তে পড়ে যেতে পারেন তিনি। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের একাধিক সদস্য গতকাল এ কথা জানিয়েছেন। এসব তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে। অপর একজন চিকিৎসক জানান, তার খাবারের রুচি নেই বললেই চলে। খাবার গ্রহণ কমে গেছে। তরল সুপের বাইরে তেমন কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না। কথা বলতে পারছেন না। মাঝে মাঝে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণও কমে যাচ্ছে। ইনসুলিন দিয়ে ডায়াবেটিস কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। মোটকথা তাঁর অবস্থা ক্রিটিক্যাল। উন্নত চিকিৎসার জন্য অতি দ্রুত বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন। 

চিকিৎসকদের বাইরে খালেদা জিয়াকে দেখতে নিয়মিত হাসপাতালে যান তাঁর পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান সিঁথি। তিনি বাসা থেকে তরল খাবার রান্না করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই দলীয় চেয়ারপারসনকে  দেখতে হাসপাতালে যান বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।  ১৩ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক প্রফেসর ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে প্রায় ২০ জনের একটি বিশেষ মেডিকেল টিম ৭৭ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসা দিচ্ছেন।

খালেদাকে বিদেশে যেতে জেলে গিয়ে নতুন আবেদন করতে হবে : আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে হলে তাঁকে জেলে গিয়ে নতুন করে আবেদন করতে হবে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ক্র্যাব) বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি। ক্র্যাব সভাপতি মিজান মালিকের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক আলাউদ্দিন আরিফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এর মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, দৈনিক যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। আইনমন্ত্রী বলেন, আইনে আছে শর্তযুক্ত, শর্তমুক্ত। খালেদা জিয়ার দরখাস্ত শর্তযুক্ত শর্তে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। সরকারকে আইনের মধ্যে থেকে কাজ করতে হয়। অনেকে ওই দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগের কথা বলছেন। কিন্তু সেই দরখাস্ত নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আমি বারবার বলে আসছি, একটা নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত, আইন অনুসারে পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা আমার নেই। তিনি বলেন, পুনরায় যদি একটি দরখাস্ত করা হয়, সেটি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমি এখানেও বলছি, সংসদেও বলেছি। শর্তযুক্ত শর্তে তিনি সাজা স্থগিতে যে মুক্তি পেয়েছেন, সেটি যদি না মেনে পুনরায় জেলে যেতে চান- সেটাও হতে পারে। কিন্তু এ অবস্থায় ফৌজদারি কার্যবিধির কোথাও নেই যে, তাঁকে আমরা আগের দরখাস্ত বিবেচনা করে বিদেশ যাওয়ার সুবিধা করে দিতে পারি। সেটা নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা টেনে যে বিভিন্ন কথা আসছে, তার ব্যাখ্যাও তুলে ধরেন আনিসুল হক। তিনি বলেন, অনেকে বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা কারও বিদেশ যাওয়া বন্ধ করে না। কিন্তু আমি কখনো বলিনি যে তাঁকে বিদেশে পাঠানো যাবে না। কিন্তু একবার নিষ্পত্তিকৃত দরখাস্ত আবার পুনর্বিবেচনা সুযোগ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় নেই। যে মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে তা আওয়ামী লীগের করা মামলা নয় বলেও জানান আইনমন্ত্রী।

 

সর্বশেষ খবর