শিরোনাম
শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

পার হলো অস্থিরতার বছর

রাজনীতি অর্থনীতি কূটনীতি সামাজিক পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে বছরজুড়েই ছিল নানামুখী সংকট

রফিকুল ইসলাম রনি ও মানিক মুনতাসির

পার হলো অস্থিরতার বছর

নানা সংকট, সংশয়, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা আর করোনা মহামারীর আতঙ্ক এবং ভোগান্তির মধ্যেই কেটে গেল আরেকটি বছর। রাজনৈতিক হানাহানি, স্থানীয় সরকার নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানি, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে নৈরাজ্যকর পরিবহন খাত, শিক্ষার্থী আন্দোলন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ধর্মীয় উন্মাদনা এবং সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনার মিছিলে কেটেছে বছরটি। রাজনীতিতে শিষ্টাচারের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল বিদায়ী বছরে। অতিকথন ও আচরণের কারণে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তির কারণে দলীয় পদ হারাতে হয়েছে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে। পরে তাকে মেয়র পদ থেকেও বরখাস্ত করা হয়। অন্যদিকে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করে পরে সমালোচনার মুখে ক্ষমা চান।

বিদায়ী ২০২১ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষ রীতিমতো যুদ্ধ করেছে জীবন-জীবিকা নিয়ে। বছরটা শুরু হয়েছিল ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আতঙ্ক নিয়ে আর শেষ হচ্ছে ওমিক্রনের উৎকণ্ঠা দিয়ে। মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে পড়ে। পিঁয়াজ, তেল, চিনি, চাল, ডালসহ প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে দফায় দফায়। বছরজুড়েই সাধারণ মানুষকে দ্রব্যমূল্যের আগুনে পুড়তে হয়েছে।

এদিকে বিদায়ী বছরের অনেক আলোচিত ঘটনার মধ্যে বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যা মামলার রায় দেওয়া হয় ৮ ডিসেম্বর। এতে অভিযুক্ত ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত।

করোনা মহামারীর কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষের আয় কমে যায়। বিপুলসংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তাদের অনেকেই এখনো কাজে ফিরতে পারেনি। ফলে তৈরি হয় সামাজিক অস্থিরতা। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, সরকারি ও বেসরকারি খাত, শিল্পকারখানা, ক্ষুদ্র ব্যবসা সব ক্ষেত্রেই বছরজুড়ে ছিল অচলাবস্থা। কৃষি ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়েছে ব্যাপক। যার ফলে ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন। আমদানি-রপ্তানিতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। কমে গেছে আমদানি-রপ্তানি। শিল্প খাতের বহু মানুষ ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে বছরজুড়েই যুদ্ধ করেছেন। অনেক শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার অনেকেই পথে বসে গেছেন। আশা করা হচ্ছে আগামী বছরটা হবে অর্থনীতির জন্য ঘুরে দাঁড়ানোর। লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার।

চলতি বছর রাজনীতির জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। বিএনপি নেতা-কর্মীদের কেটেছে দলটির চিকিৎসাধীন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আন্দোলন নিয়ে। খালেদা জিয়াকে ‘মুক্তি’ দিয়ে বিদেশ পাঠানোর দাবিতে আন্দোলনে মাঠে নামে দলটি। কিন্তু কোনো ফল ঘরে তুলতে পারেনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেটেছে কোন্দল, হানাহানি আর নেতা-এমপি-মন্ত্রীদের অতিকথনে। যার শুরুটা করেছিলেন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মির্জা কাদের। নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মির্জা কাদেরের নির্বাচন, স্থানীয় এমপি, প্রশাসন, বড় ভাইসহ নানা বিষয়ে ‘সত্যবচন’ বছরের একটা বড় সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলে। বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ও সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। ১৮ আগস্ট রাতে বরিশাল সদর উপজেলা পরিষদ চত্বরে অবৈধ ব্যানার-বিলবোর্ড অপসারণ কেন্দ্র করে সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করেন আনসার সদস্যরা। এতে বিসিসির প্যানেল মেয়র ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ওসিসহ ৬০ জন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় তখন আওয়ামী লীগ ও আমলাদের মধ্যকার ‘দূরত্ব’ দেশব্যাপী আলোচনায় আসে। অতিকথন ও নারীবিদ্বেষী বক্তব্য এবং বিতর্কিত একটি অডিও ফাঁস হওয়ায় মন্ত্রিত্ব হারান তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। মন্ত্রিত্ব হারিয়ে তিনি দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু কানাডায় তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তাই তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়। বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড। বছরের প্রথম দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর কেন্দ্র করে মাঠে নেমেছিল হেফাজতে ইসলাম। তারা ঢাকা ও বাইরে ব্যাপক নাশকতা করে। এর পরই হেফাজত নেতা মামুনুল হক একটি হোটেলে গ্রেফতার হন নারীসহ। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত হয়। এতে প্রকাশ পায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার উপস্থিতি। আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনের ঘটনা। এবার পূজার সময় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাও ঘটে। ঢাকার পাশের রূপগঞ্জে একটি কারখানায় ৫৫ জন নিহত হন আগুনে। সব শেষ এ মাসে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে ৪১ জনের প্রাণহানি এবং কয়েক শ জনের দগ্ধ হওয়ার ক্ষত সবার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশন-ইসি গঠনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করলেও ইতিমধ্যে দুটি দল যায়নি। বিএনপি এখন পর্যন্ত না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তে রয়েছে। চলতি বছর সংলাপ শুরু হলেও আগামী বছর পর্যন্ত চলবে। সুষ্ঠু ভোট ও গণতন্ত্র নিয়ে দেশের মানুষের প্রত্যাশা রয়েছে অনেক।

কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বিরাজ করেছে অস্থিরতা। বছরের শুরুতে করোনার ভ্যাকসিন বাজারে এলে শুরু হয় ভ্যাকসিন রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে সংকটময় সময়ে ভারত বাংলাদেশকে ভ্যাকসিন সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরপর ভ্যাকসিন কূটনীতিতে আসে নতুন মোড়। সরকার তাৎক্ষণিকভাবে চীন, আমেরিকা, রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফলে রাশিয়া, চীন ও আমেরিকা থেকে ভ্যাকসিন আসতে থাকে। যদিও তাতে কিছুটা বিলম্ব হয়। এতে সংক্রমণ কিছুটা বেড়েও যায়। অবশেষে নানা উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করে গণহারে প্রয়োগ করে সরকার। দেশের প্রায় ৭ কোটি মানুষ এখন ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছে। বিদায়ী বছরটা ছিল মুজিববর্ষের অংশ। ফলে বছরের বেশির ভাগ সময় মুজিববর্ষ ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর বিভিন্ন অনুষ্ঠান ছিল। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। এটি সরকারের জন্য একটা বড় ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য। করোনা মহামারীর অচলাবস্থার মধ্যেও সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সশরীরে যোগ দেন ভারতের রাষ্ট্রপতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলন ‘সামিট ফর ডেমোক্র্যাসি’তে বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। বছরের প্রায় শেষ প্রান্তে ১১ ডিসেম্বর পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ র‌্যাবের ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে কিছুটা চাপে পড়ে সরকার। তবে সরকারের তীব্র প্রতিক্রিয়ার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনকে ফোন করেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে না দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করে বলেন, খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে আমেরিকা মানবাধিকার-গণতন্ত্রের সবক দেয়!

ঢাকাসহ সারা দেশের পরিবহনে নৈরাজ্য ছিল বছরজুড়ে আলোচনায়। বছরজুড়েই ঘটেছে অনেক বড় বড় দুর্ঘটনা। রাস্তায় প্রাণ হারিয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে ও হাফ ভাড়া কার্যকরের দাবিতে রাস্তায় নেমে আসে শিক্ষার্থীরা। বিদায়ী বছরের শেষ প্রান্তে বরগুনাগামী একটি বড় লঞ্চ মাঝনদীতে অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয়। আগুন ধরে পুড়ে যায় ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চটি। এতে অন্তত ৪০ যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। বছরের পুরো সময়জুড়েই দ্রব্যমূল্য ছিল লাগামহীন। বাজারের এ ঊর্ধ্বমুখিতা এখনো বিরাজমান। আগামীকাল শুরু হবে নতুন বছর ২০২২। কেটে যাক সব সংকট, সংশয়, অস্থিরতা আর অরাজকতা। নতুন বছর হোক সবার জন্য কল্যাণকর। এটাই প্রত্যাশা দেশবাসীর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর