শুক্রবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দলীয় চেয়ারপারসনকে নিয়ে উৎকণ্ঠার বছর বিএনপির

শফিউল আলম দোলন

দলীয় চেয়ারপারসনকে নিয়ে উৎকণ্ঠার বছর বিএনপির

প্রতিষ্ঠার ৪৩ বছরে এসে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে বিএনপি। বিদায়ী ২০২১ সালের পুরোটা কেটেছে শঙ্কা, হতাশা, দুশ্চিন্তা আর দল গোছানোর ব্যস্ততায়। বিশেষ করে বছরের শেষ অর্ধেকটা কেটেছে হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে। তাঁর মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে মাঝে-মধ্যেই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে হয়েছে। এর ফলে দল গোছানোর কাজে গতি কমেছে। অন্যদিকে সারা দেশে সাংগঠনিক জেলা, উপজেলাসহ তৃণমূল কমিটি গঠনেও আশানুরূপ সাফল্য পায়নি দলটি। দেশব্যাপী ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ৩০টিতে কমিটি গঠন সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যেও অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি আর কমিটি বাণিজ্যের কারণে বেশির ভাগ কমিটি থেকে ত্যাগী, পরীক্ষিত আর যোগ্য ও আন্দোলনমুখী নেতারা বাদ পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগকারীরা দাবি করেছেন, যোগ্য-পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের বিপরীতে আন্দোলনবিমুখ, চাটুকার, তেলবাজ, অথর্ব, অযোগ্য নেতারাই বিভিন্ন কমিটিতে স্থান করে নিচ্ছেন। কমিটি গঠন নিয়ে দলটির তৃণমূলে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তৃণমূল নেতাদের মতে, বিদেশে চিকিৎসার অভাবে দলের সর্বোচ্চ শীর্ষনেতা মৃত্যুপথযাত্রী। এখনো যদি আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা না করেন তাহলে- আর করবেনটা কবে? বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের দাবি- বিদায়ী বছরে সারা দেশে তাদের দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ২০ হাজার মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দল ও সরকার। টানা দেড় দশক ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি একদিকে যেমন মামলা-হামলা আর দমন-পীড়নে নাস্তানাবুদ, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্বশূন্যতার কারণে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে প্রতিনিয়ত।

গত এক বছর দল গোছানোর অংশ হিসেবে ৮১টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে অন্তত ৩০টিতে নতুন কমিটি দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে কয়েকটি জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটিও রয়েছে। এ ছাড়াও সারা দেশে তিন শতাধিক পৌর, উপজেলা ও থানা ইউনিটের কমিটিও গঠন করেছে। তবে এসব কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ত্যাগীদের বাদ দেওয়া, মৃত, প্রবাসী ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের রাখারও অভিযোগ উঠেছে। বেশ কয়েকটি ইউনিটে পাল্টাপাল্টি কমিটিও হয়েছে। শুধু মূল দল নয়, অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনেও তৃণমূল পর্যন্ত ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের তৃণমূলের সব পর্যায়ে কমিটি গঠন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মহিলা দলও অধিকাংশ সাংগঠনিক জেলার শাখা কমিটি গঠন করেছে। 

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের পর থেকেই সাংগঠনিক জেলা পুনর্গঠনে মনোযোগ দেয় বিএনপি। এ পর্যন্ত পঞ্চগড়, সৈয়দপুর, বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ, যশোর, মাগুরা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, ময়মনসিংহ মহানগর, ময়মনসিংহ উত্তর ও দক্ষিণ, নেত্রকোনা, গাজীপুর জেলা, নারায়ণগঞ্জ জেলা, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, সিলেট জেলা, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উত্তর, গাজীপুর মহানগর, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল মহানগর, বরিশাল উত্তর ও দক্ষিণ, চুয়াডাঙ্গা, টাঙ্গাইল, সিলেট মহানগর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, খুলনা জেলা ও মহানগর, রাজশাহী জেলা ও মহানগরসহ ৫৫টি সাংগঠনিক  জেলায় আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে এ বছরে কমিটি করেছে ৩০ জেলা শাখার।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। করোনা মহামারীর কারণে দল পুনর্গঠনের কাজ আমরা সেভাবে করতে পারিনি। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় আসার পর মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলা শাখার অনেকগুলো কমিটি হয়েছে। বাকি জেলা কমিটিগুলোর পুনর্গঠনের কাজ চলছে। পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ থানা-উপজেলা-ইউনিয়নসহ তৃণমূলের সব পর্যায়ের কমিটি দ্রুত শেষ করতে জেলা নেতাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে। এদিকে বিএনপির কমিটি গঠনে বেশ কয়েকটি জেলায় হ-য-ব-র-ল অবস্থারও সৃষ্টি হয়েছে। অধিকাংশ কমিটি গঠনে নানা অভিযোগ কেন্দ্রীয় দফতরে জমা পড়েছে। এতে যোগ্যদের বাদ দেওয়া, মৃত, প্রবাসী ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের কমিটিতে রাখাসহ নানা অনিয়মের কথা জানান স্থানীয় নেতারা। তারা বলেন, দলের নেতা-কর্মীরা আগামী দিনে আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলছেন, কিন্তু যাদের দিয়ে দল পুনর্গঠন করা হচ্ছে তাদের দিয়ে আন্দোলন সফল করা যাবে না। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয় নাটোরের কয়েকটি ইউনিটের কমিটি গঠন নিয়ে। বাগাতিপাড়ায় উপজেলা ও পৌর এবং গোপালপুর পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে মৃত ব্যক্তিদের পদ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। যা পরে প্রমাণিতও হয়। একই অভিযোগ উঠে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর পৌরসভা বিএনপির কমিটি গঠন নিয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। রাজবাড়ী জেলার কমিটি নিয়েও নানা অভিযোগে ওঠে। গোয়ালন্দ উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুলতান নুর ইসলামের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা গোয়ালন্দ প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, গোয়ালন্দ উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা, কর্মিসভা বা বর্ধিত সভা না করে জেলা আহ্বায়ক কমিটি ১৮ অক্টোবর রাতের অন্ধকারে উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছে। আহ্বায়ক কমিটির ৭, ৮ ও ২৭ নম্বর সদস্য এখনো আওয়ামী লীগের কর্মী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, পাবনা, নড়াইল, নোয়াখালীসহ বেশ কয়েকটি জেলার অধীনে থাকা উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে পাল্টাপাল্টি কমিটিও হয়। বগুড়ায় বিএনপির পুনর্গঠনের কাজ শেষ না হতেই গত ১৩ নভেম্বর দলের জেলা আহ্বায়ক কমিটিতে রদবদল করা হয়। এতে বগুড়া জেলার আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ এমপিকে বাদ দেওয়া হয়। নতুন আহ্বায়ক করা হয় রেজাউল করিম বাদশাকে। দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি গত এক বছরে সবচেয়ে মনোযোগ দিয়েছে ঢাকাসহ সারা দেশের মহানগর কমিটি গঠন নিয়ে। এর মধ্যে ডিসেম্বরেই ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণে ওয়ার্ডভিত্তিক কর্মিসভা শেষ করা হয়েছে। শিগগিরই কাউন্সিল করে থানা ও ওয়ার্ডের কমিটি ঘোষণা করা হবে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মিসভা প্রায় শেষ হয়েছে। আশা করছি নতুন বছরে জানুয়ারির মধ্যেই থানা ও ওয়ার্ডের সব কমিটি দিতে পারব। আমরা সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে কাউন্সিল করে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে কমিটি দেব। একই কথা জানিয়েছেন মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম। তিনি বলেন, সব থানা ও ওয়ার্ডেই কমিটি গঠনের লক্ষ্যে কর্মিসভাগুলো চলছে। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই সবগুলো কমিটি দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করি।

সর্বশেষ খবর