রবিবার, ২ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

৪০ লাখ মামলার পাহাড়

♦ বিচারকের সংখ্যার হিসাবে ’৭২ সালের অবস্থানে আপিল বিভাগ ♦ আজ এজলাসে বসছেন নতুন প্রধান বিচারপতি

আরাফাত মুন্না

৪০ লাখ মামলার পাহাড়

হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আজ এজলাসে বসছেন

প্রায় ৪০ লাখ মামলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ এজলাসে বসছেন দেশের নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ২১ মাস দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাওয়া এই প্রধান বিচারপতির সামনে বিচার বিভাগের অন্য সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি মামলাজট নিরসনই বড় কাজ হিসেবে দেখছেন আইনজ্ঞরা। এদিকে নতুন প্রধান বিচারপতির এজলাসে বসার দিন বিচারক সংকট চরমে পৌঁছেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে থাকা আপিল বিভাগের আজকের কার্যতালিকায় মাত্র তিনজন বিচারপতির নাম রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগও তিনজন বিচারপতি নিয়েই যাত্রা শুরু করেছিল। যদিও তখন আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলা ছিল ৪ হাজার ৫৬টি। আর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বর্তমান সময়ে আপিল বিভাগের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি।

এদিকে গতকাল সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ সময় আপিল বিভাগের দুই বিচারক বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ছিলেন। এর আগে বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগের বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে দেশের ২৩তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে শুক্রবার বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে শপথ পড়ান তিনি। নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর অবসরে যাবেন। সে হিসেবে ২১ মাস দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন তিনি।

আইনজ্ঞদের মতে, নতুন প্রধান বিচারপতির সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৪০ লাখ মামলার জট কমিয়ে আনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ছাড়া আপিল বিভাগের বিচারক স্বল্পতা নিরসন, বিচারাঙ্গনের দুর্নীতি-অনিয়ম রোধ, করোনাসহ নানা সংকটকালীন মুহূর্তে বিচারব্যবস্থা সচল রাখতে ভার্চুয়াল আদালত ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, বিচার বিভাগের ডিজিটাইলেজশন ও যুদ্ধাপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করাও নতুন প্রধান বিচারপতির সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মামলাজট ছাড়া আর কোনো সমস্যাই আমার কাছে বড় মনে হয় না। প্রায় ৪০ লাখ মামলার জট। এই বিশাল পরিমাণ মামলা না কমানো গেলে বিচারপ্রার্থী জনগণের দুর্ভোগ দূর করা যাবে না। নতুন প্রধান বিচারপতিকে অবশ্যই মামলাজট কমানোর বিষয়ে ভাবতে হবে।’ এ ছাড়া বিচারাঙ্গনের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধেও প্রধান বিচারপতিকে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আরেক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামলাজট নিরসন, অনিয়ম-দুর্নীতি রোধ করার পাশাপাশি নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে ডিজিটালাইজেশন করা। তিনি বলেন, ‘এখনো আমরা মামলা ফাইল করি ম্যানুয়াল সিস্টেমে। সেকশনগুলোতে ফাইলের স্তূপ। অনেক সময় শুনানি করতে গেলে ফাইল খুঁজে পাওয়া যায় না। যত দিন বিচার বিভাগ পুরোপুরি ডিজিটাল না হবে, তত দিন বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও লাঘবও হবে না। আলতাফ হোসেন বলেন, প্রধান বিচারপতির জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বিচারক স্বল্পতা দূর করা। বিচারক কম হলে মামলাজটও কমবে না। বিচারাধীন থাকা গুরুত্বপূর্ণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করাও নতুন প্রধান বিচারপতির চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছেন এই আইনজীবী।

বিচারক সংকটের চরমে আপিল বিভাগ : বিচারক সংকটের চরমে পৌঁছেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আজকের আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় মাত্র তিনজন বিচারপতির নাম রয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে সর্বোচ্চ ১১ জন বিচারপতি ছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালেও আপিল বিভাগে ছিলেন ৯ জন বিচারপতি। সর্বশেষ গত ৩০ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অবসরে গেলে আপিল বিভাগে বিচারক সংখ্যা চারে দাঁড়ায়। এরপর প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়ার পর আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী লম্বা ছুটিতে গেছেন বলে জানা গেছে। তবে ছুটি ঠিক কত দিন, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা দাঁড়ায় তিনে। আপিল বিভাগের এই সংকট দূর করতে দ্রুত বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইনজীবীরা।

মৃত বঙ্গবন্ধু বেশি শক্তিশালী- প্রধান বিচারপতি : নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, মৃত বঙ্গবন্ধু জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বেশি শক্তিশালী। বিচারপতিরা বঙ্গবন্ধুকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে রেখে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। গতকাল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে এ মন্তব্য করেন তিনি। এর আগে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন ঘুরে দেখেন প্রধান বিচারপতি। এ সময় আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান ননী ও বিচারপতি ওবায়দুল হাসান তাঁর সঙ্গে ছিলেন। পরে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমার মনে হয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বটে, তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকবেন মানুষের মধ্যে এবং বাংলার আনাচকানাচে। আমরা বঙ্গবন্ধুকে অনুভব করি। মৃত বঙ্গবন্ধু এখন জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।’ তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে ১৫ আগস্ট আমরা সুপ্রিম কোর্টে অনুষ্ঠান করেছি। সব বিচারপতি ওনাকে (বঙ্গবন্ধু) শ্রদ্ধা নিবেদন করে কথা বলেছেন। এখান থেকে আমার মনে হয়, জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক অনেক বেশি শক্তিশালী। যারা বঙ্গবন্ধুকে মারতে চেয়েছিলেন তারা মেরেছেন ঠিকই কিন্তু বঙ্গবন্ধু মরেননি, তিনি আমাদের মনে জীবিত আছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর