বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

সেরাদের উড়িয়ে শ্রেষ্ঠ জয়

মেজবাহ্-উল-হক

সেরাদের উড়িয়ে শ্রেষ্ঠ জয়

আনন্দ মিছিল নেই। উচ্ছ্বাস নেই। বাংলার ঘরে ঘরে উন্মাদনার চিৎকার নেই। নীরবে-নিভৃতে চলে এলো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সুন্দরতম দিন। টেস্ট ক্রিকেটে সময়ের সেরা দল নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে ৮ উইকেটে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশ পেল ক্রিকেট ইতিহাসে ‘শ্রেষ্ঠ’ জয়। অবিস্মরণীয় এক জয়। বিধ্বংসী এক জয়। স্বপ্নের এক জয়। ক্যারিশমাটিক এ বিজয়ে গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ। শীতের সকালে আড়মোড়া ভেঙেই বাংলাদেশ দেখল সোনার ছেলেরা সাড়ে ১১ হাজার কিলোমিটার দূরে তাসমান সাগরপাড়ের শহর নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে সৃষ্টি করেছে ক্রিকেটের নতুন ইতিহাস। টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের রীতিমতো গুঁড়িয়ে দিয়েছেন মুমিনুল-ইবাদতরা। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধেও এটি বাংলাদেশের প্রথম জয়। ক্যাপ্টেন মুমিনুল হকের কাছে এটি ক্রিকেট ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জনও। গতকাল ম্যাচ শেষে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় এ-ই আমাদের ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ অর্জন। এখন আমাদের যে পরিস্থিতি, মানে যে অবস্থায় আমরা ছিলাম সে অবস্থা থেকে আমার মনে হয় এটা অনেক বড় (সাফল্য)। আর নিউজিল্যান্ডের মতো কঠিন কন্ডিশনে আমাদের জন্য এটা অনেক বড় অর্জন।’ টি-২০ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্টে ‘লন্ডভন্ড’ একটি দল, যাদের স্কোয়াডে নেই সেরা তিন তারকা সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (অবসর)। তারুণ্যনির্ভর ‘আনকোরা’ দলটি নিয়ে ক্যাপ্টেন মুমিনুল হক নিউজিল্যান্ডে পা রেখেই একের পর সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে থাকেন। যাত্রাপথে এয়ার ক্রাফটে একজন করোনা আক্রান্ত হওয়ায় পুরো দলের কোয়ারেন্টাইনের মেয়াদ বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সব বাধা অতিক্রম করে প্রথম ম্যাচেই বাজিমাত করে দিল টিম টাইগার্স। এ দলটি এমন এক কান্ড ঘটিয়ে ফেলল যা গত এক যুগে উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশ করতে পারেনি। এ টেস্টে বাংলাদেশ জয়ের ইঙ্গিতটা পেয়েছিল চতুর্থ দিন শেষেই। অবশ্য এমন ইঙ্গিত আরও অনেক টেস্টেই পেয়েছিল টাইগাররা। শেষ পর্যন্ত স্নায়ুর লড়াইয়ে টিকতে পারেনি। তাই সেই ম্যাচগুলোয় জয়ও আসেনি। কিন্তু গতকাল দেখা গেল অন্য বাংলাদেশ দলকে। যে দলের ক্রিকেটাররা আবেগ চাপা দিয়ে রেখে ইস্পাতকঠিন মনোবল নিয়ে ‘বে ওভালে’ পঞ্চম দিন খেলতে নামেন। শেষ দিনে প্রধান বাধা ছিল কিউই তারকা ব্যাটসম্যান রস টেলর। আগের দিনের ‘আগুনে’ বোলার ইবাদত হোসেন গতকাল শুরুতেই সে বাধা দূর করে ফেলেন। টেলরকে সরাসরি বোল্ড করেন। এরপর বাকিদের আউট করতে আর কোনো বেগ পেতে হয়নি। আগের দিনের ১৭ রানের লিডের সঙ্গে গতকাল ৫ উইকেট হারিয়ে আর মাত্র ২২ রান যোগ করতে পেরেছেন স্বাগতিকরা। সব মিলে লিড মাত্র ৩৯ রান। ৪০ রানের জয়ের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ২ উইকেট হারিয়ে জিতে যায় বাংলাদেশ। ৪৬ রানে ৬ উইকেট নিয়েছেন ইবাদত হোসেন। দেশের বাইরে বাংলাদেশের কোনো পেসারের এটিই সেরা বোলিং ফিগার। তাই ঐতিহাসিক ম্যাচে সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারও পেয়েছেন সিলেটের এই পেসার। দুর্দান্ত বোলিং করেছেন তাসকিন আহমেদও। তিনি ৩৬ রানে নিয়েছেন ৩ উইকেট। কিউইদের ওপর দারুণভাবে চাপ প্রয়োগ করেছেন অন্য দুই বোলার শরিফুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান মিরাজও। বাংলাদেশের স্মরণীয় এ জয় দলীয় সমন্বয়ের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। প্রথম ইনিংসে দলীয় স্কোর ৪৫৮ রান হলেও কোনো সেঞ্চুরি নেই। চারটি হাফ সেঞ্চুরি। গতকাল ফিল্ডিংও দুর্দান্ত করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের শেষ ব্যাটসম্যান বোল্টকে আউট করতে সুপার হিসেবে ফিল্ডিংয়ে নামা তাইজুল ডিপ মিডউইকেটে শূন্যে লাফিয়ে যে ক্যাচটি লুফে নিয়েছেন তা টেস্টের ইতিহাসের সেরা ক্যাচগুলোর একটি হয়ে থাকবে! ঘরের মাঠে নিজেদের পছন্দের ফরম্যাট ওয়ানডেতে ব্লাকসদের একাধিকবার হোয়াইটওয়াশ করলেও নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের জয়টা ছিল অধরা। সেই ২০০১ সাল থেকে নিউজিল্যান্ড সফর টাইগারদের। তিন ফরম্যাট মিলে আগের ৩২ ম্যাচে কোনো জয় আসেনি। অবশেষে ৩৩তম ম্যাচে এলো কাক্সিক্ষত জয়। ২১ বছর অপেক্ষার অবসান ঘটল। নিউজিল্যান্ডের মাটি বরাবরই এশীয় ক্রিকেটশক্তিদের জন্য বধ্যভূমি। নিউজিল্যান্ড সফর মানেই ‘মিশন ইমপসিবল’! এক যুগ আগে সেই ২০১১ সালে টেস্টে কিউইদের সবশেষ হারিয়েছিল পাকিস্তান। এরপর আর কোনো দল জিততে পারেনি টেস্ট। এমনকি টেস্টের শীর্ষে থাকা ভারতও নয় (সবশেষ জিতেছিল ২০০৯ সালে)। বিরাট কোহলির পরাক্রমশালী টেস্ট দলটিও সবশেষ আসরে নিউজিল্যান্ড গিয়ে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে। সেই বধ্যভূমিতে এবার সাফল্যের ফুল ফোটাল বাংলাদেশ। নতুন ইতিহাস লিখলেন মুমিনুলরা। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টাইগারদের এ জয়ে একটি চরম সত্যও উদ্ঘাটিত হয়েছে। এক একজন তারকায় হয়তো মিটমিট করে আলো জ্বলে, কিন্তু একটি দল যখন দল হিসেবে খেলে তখন তা সূর্যের আলোর মতো চারদিক উদ্ভাসিত করে। এ সত্য মেনে নিয়ে এগিয়ে চললে হয়তো এমন জয়কে আর ‘অঘটন’ মনে হবে না। আজকের দিনের ‘অঘটন’ তখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হবে। বাংলাদেশের ক্রিকেট পৌঁছে যাবে অনন্য উচ্চতায়।

সর্বশেষ খবর