বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢাকা-চট্টগ্রামের দুঃখ রেলগেট

দ্বিস্তরবিশিষ্ট যোগাযোগব্যবস্থা বা ওভারপাস আন্ডারপাস করার প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের

শামীম আহমেদ, ঢাকা ও সাইদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম

ঢাকা-চট্টগ্রামের দুঃখ রেলগেট

ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে রেলগেটের যানজটে শুধু মূল্যবান কর্মঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে না, পদে পদে ভয়াবহ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এ সংকট দূর করতে বিশেষজ্ঞরা বারবার দুই বা তিন স্তরবিশিষ্ট যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলা অথবা রেলগেটে ওভারপাস ও আন্ডারপাস নির্মাণের তাগিদ দিলেও নেওয়া হচ্ছে না উদ্যোগ। মূল শহরে এভাবে অধিক পরিমাণ রেলগেট শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যেরই ক্ষতি করছে না, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজে যাতায়াতসহ সব কাজে বিঘ্ন     ঘটাচ্ছে। অনেক সময় রেলগেটের যানজটেই অ্যাম্বুলেন্সে মৃত্যু হচ্ছে মুমূর্ষু রোগীর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের যানজটের অন্যতম কারণ রেলগেট। মূল শহরে যানজট নিরসনে রেলকে সড়কের ওপর দিয়ে অথবা মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশ দুই বা তিন স্তরবিশিষ্ট যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলছে। নিচে সড়ক, ওপরে রেল বা মেট্রোরেল, আবার কমিউটার ট্রেনের জন্য আলাদা লাইন। ফলে শহরের মধ্যেই ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে বুলেট ট্রেন চলছে। কোনো দুর্ঘটনাও ঘটছে না, রেলের কারণে যানজটও হচ্ছে না। এটাই টেকসই উন্নয়ন। রেলগেটে ওভারপাস বা আন্ডারপাস নির্মাণ করেও এ সংকট দূর করা যায় বলে মনে করছেন কেউ কেউ।

সংশ্লিষ্টদের মতে দ্বিস্তরবিশিষ্ট যোগাযোগব্যবস্থা অথবা রেলগেটে ওভারপাস-আন্ডারপাস নির্মাণ করার সক্ষমতা বর্তমানে রেলের রয়েছে। সিটি করপোরেশন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ও চাইলে ওভারপাস-আন্ডারপাস নির্মাণের কাজটি করতে পারে। রেলগেটের এ সংকট কেটে গেলে শুধু যানজটই দূর হবে না, বদলে যাবে নাগরিক জীবন। মূল্যবান কর্মঘণ্টা বাঁচবে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। যানজটে অহেতুক জ্বালানি অপচয় হবে না। পরিবেশ দূষণ কমবে। যোগাযোগ খাতে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন তৎপরতা, অনেক ফ্লাইওভার নির্মাণে জনজীবনে অনেকটা স্বস্তি এলেও রেলগেটের কারণে দুর্ভোগ কমছে না। ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরেও একই অবস্থা বিদ্যমান।

জানা গেছে, রাজধানীসহ আশপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে রেলগেট বা রেলক্রসিং রয়েছে ৫৮টি। এর ২৩টি অরক্ষিত ও অননুমোদিত। চট্টগ্রামের মেইন লাইনসহ শহর এলাকার মধ্যে ৫৫টি রেলক্রসিং রয়েছে। এসব ক্রসিংয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকছে গাড়ি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে প্রতিদিন ১১৪টি ট্রেন যাতায়াত করে। এজন্য প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে ১১৪ বার প্রতিবন্ধক ফেলে বন্ধ করা হয় গাড়ি চলাচল। গড়ে প্রতিবার ৩ মিনিট করে বন্ধ রাখলে একটি ক্রসিংয়েই দিনে যানবাহন বন্ধ থাকে ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। কখনো তা ৭-৮ ঘণ্টায় গিয়ে দাঁড়ায়। রাজধানীতে প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে ৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট করে গাড়ি আটকে থাকলে সব রেলক্রসিংয়ে এক দিনেই নষ্ট হয় ৩৩০ কর্মঘণ্টা, যা প্রায় ১৪ দিনের সমান। এ ছাড়া রেলক্রসিং খুলে দেওয়ার পরও সড়কে এর প্রভাব রয়ে যায় দীর্ঘ সময়। গাড়ির চাপ কমে আসার আগেই আবার চলে আসে অন্য ট্রেন। বন্ধ হয় রেলগেট। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে- ঢাকার যানজটের কারণে দেশের জিডিপিতে প্রতি বছর ক্ষতির পরিমাণ আড়াই শতাংশ। পরোক্ষ ক্ষতি যোগ করে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮ শতাংশে। গবেষণাটি করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও পিআরআইয়ের পরিচালক ড. আহমেদ আহসান। তিনি বলেন, যানবাহনের চাপ সবচেয়ে বেশি এয়ারপোর্ট রোড, মহাখালী ও ফার্মগেট এলাকায়। প্রসঙ্গত, এ তিনটি এলাকাতেই রয়েছে রেলগেট। কয়েক বছর আগে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় দৈনিক ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এদিকে সরকার রেলের উন্নয়নে ৩০ বছর মেয়াদি (২০১৬-২০৪৫) মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার সঙ্গে কক্সবাজার, মোংলা বন্দর, টুঙ্গিপাড়া, বরিশাল, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে ও আঞ্চলিক রেলওয়ে যোগাযোগ স্থাপন, উন্নত কমিউটার ট্রেন সার্ভিস চালুসহ ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। বর্তমানে রেলওয়ের ৩৬টি প্রকল্প চলমান, যার অধিকাংশই ভূমিতে রেললাইন সম্প্রসারণ ও উন্নয়নকেন্দ্রিক। এর মধ্যে রেলেগেটের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়নে দুটি প্রকল্প থাকলেও আন্ডারপাস বা ওভারপাস নির্মাণের কোনো বিষয় সেখানে নেই। রেলের পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং গেটসমূহের পুনর্বাসন ও মানোন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক বীরবল মন্ডল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তার প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন অবৈধ রেলগেটকে বৈধতা ও গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ‘রেলগেট এখন নগরীর বিষফোঁড়া। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছামতো রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা বানিয়েছে। প্রতি কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত একটি রেলগেট হয়েছে। এ সংকট থেকে মুক্তি পেতে রেলকে মাথার ওপর দিয়ে নিতে হবে। সড়ক থাকবে নিচে। এতে প্রাথমিকভাবে খরচ বেশি হলেও উন্নয়নটা টেকসই হবে। আর এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের সক্ষমতা এখন আমাদের আছে। কিন্তু তেমন উদ্যোগ না নিয়ে ভূমিতেই রেলকে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, যা পরবর্তীতে সংকট বাড়াবে।’ তিনি বলেন, রেলগেটে ওভারপাস বা আন্ডারপাস করেও সমাধান করা যেত। তবে ঘন ঘন রেলক্রসিং এবং বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি হয়ে যাওয়ায় তা এখন কঠিন। বুয়েটের এ অধ্যাপক বলেন, টেকসই উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সুফল ও ক্ষতি চিন্তা করা দরকার। একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থা মান্ধাতা আমলে রয়ে গেছে। নতুন প্রকল্পগুলোও একই আদলে হচ্ছে। এতে অর্থ ব্যয় হচ্ছে ঠিকই, সমস্যা দূর হচ্ছে না। উল্টো পরে এগুলো ভেঙে আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থা গড়তে সমস্যা হবে। তিনি বলেন, জাপান, হংকং, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ মূল শহরে একাধিক স্তরবিশিষ্ট যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। টোকিওতে ২ কোটি মানুষের বাস। তবু সেখানে ৩৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলে। সেখানে তিন স্তরবিশিষ্ট পরিবহনব্যবস্থা। ঢাকায় ট্রেন চলে ৩০ কিলোমিটার গতিতে। এজন্য রেলগেটও বন্ধ থাকে বেশি সময়। নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাষচন্দ্র বড়ুয়া বলেন, মেট্রোরেল আর লম্বা লম্বা ফ্লাইওভার করলে যানজট কমবে না। এখানে ১৯৯৫ সালে দেওয়া মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কেউ কাজ করছেন না। বিজ্ঞজনদের মতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না কেউ। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে ওভারপাস থাকার কথা কিন্তু তা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনা ও যানজট তৈরি হচ্ছে। সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু মানুষ সুফল পাচ্ছে না। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-অপারেশন) সরদার শাহাদাত আলী বলেন, রেলওয়েতে একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। অবৈধ রেলক্রসিং বন্ধ করাসহ ক্রসিং ঘিরে নানা উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর