শুক্রবার, ৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

উন্নয়নে স্বস্তি ভোটে অস্বস্তি

♦ তিন বছর শেষ করে চার বছরে পা রাখবে সরকার ♦ মানবাধিকার ও আইনশৃঙ্খলায় প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থান দেশ-বিদেশে

জুলকার নাইন ও রফিকুল ইসলাম রনি

অবকাঠামো উন্নয়নে স্বস্তি ও ভোটে অস্বস্তি নিয়ে চলতি মেয়াদের তিন বছর পার করল আওয়ামী লীগ সরকার। আজ চার বছরে পা রাখছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন এই সরকার। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সরকারের বর্তমান মেয়াদের তিন বছরের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে মহামারি মোকাবিলায়। বৈশ্বিক এই দুর্যোগেও বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ছিল চোখে পড়ার মতো সচল। বিরূপ এই পরিস্থিতিতেও মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ প্রশংসনীয়ভাবে চালিয়ে যেতে পেরেছে সরকার। কিন্তু মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচিত হয়েছে। সর্বশেষ র‌্যাব ও এর কর্মকর্তাদের যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় সৃষ্টি হয়েছে বিব্রতকর পরিস্থিতির।

পাশাপাশি গত তিন বছরে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে হত্যাকা-ের সঙ্গে বেড়েছে সামাজিক খুনোখুনিও। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দাপট বেড়েছে আমলাদের। এই সময়ে দলের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব বেড়েছে। মন্ত্রীদের নানা কর্মকা-ে পড়তে হয়েছে সমালোচনায়। কিন্তু সবকিছু একহাতে সামলিয়ে ও নিজ কর্মদক্ষতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণ। করোনা মোকাবিলাসহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারায় সফল নেতৃত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী প্রশংসিত হয়েছেন দেশে-বিদেশে।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ করে। এর আগে বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বর্জনের মুখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনেও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট। তার আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। সে হিসাবে টানা ১৩ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

জানা যায়, সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত পদ্মা সেতু এখন উদ্বোধনের অপেক্ষায়। গত বছরের শেষ দিন স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ঢাকাবাসী এরই মধ্যে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল দেখেছে। চলতি বছরে এই ট্রেন যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম টানেলও চালু হবে এ বছর। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। উদ্বোধন করা হয়েছে পায়রা বন্দর সেতু, যা দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। করোনা মহামারির মধ্যেও গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যখন শক্তিশালী দেশগুলো করোনার টিকা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ করে দেশব্যাপী গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যেই রেকর্ড গড়ে বেড়েছে রিজার্ভের পরিমাণ। জিডিপি ও মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের চ্যালেঞ্জগুলোও ধারাবাহিক সাফল্যের সঙ্গে পার করছে সরকার। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন হয়েছে দাপটের সঙ্গেই।  রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকারের তিন বছরের দুই বছরই কেটেছে করোনা মোকাবিলা করে। এ সময়ে শক্ত হাতে করোনা মোকাবিলা করে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখাই বড় সাফল্য। করোনার শুরুতে অনেকেই মনে করেছিলেন, আমাদের দেশের মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। অর্থনীতি ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে সবকিছু সফলভাবে পরিচালিত হওয়ায় বিশ্বে প্রশংসিত হচ্ছে। ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যেও অগ্রগতি হয়েছে।’

ড. মীজানুর রহমানের মতে, তিন বছরে বর্তমান সরকারের সাফল্য ব্যাপক হলেও ব্যর্থতাও কম নয়। এর মধ্যে পুরোপুরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- যা নিয়ে আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আবার দুর্নীতিও বন্ধ হয়নি। এখানে সরকারের কাজ করার সুযোগ ছিল। কিন্তু তা হয়নি।

সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ২০টি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুতির প্রথম কাতারে আছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ’।  কিন্তু এ নীতি ঘোষণা করেও দুর্নীতির লাগাম টানা যায়নি। টিআইবির দুর্নীতির ধারণা সূচকের তথ্য অনুযায়ী সরকার ক্ষমতা গ্রহণকালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পেছনের দিক থেকে ১৪তম। ২০২০ সালে সেই অবস্থান দুই ধাপ অবনতি হয়ে ১২তম স্থানে নেমেছে। এর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগে নিয়োগ বাতিল করার বিষয়টি সরকারকে ব্যাপক সমালোচনায় ফেলেছে। উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগও ছিল চোখে পড়ার মতো। অন্যদিকে টানা এক যুগের বেশি সময় রাজনীতির মাঠ দখলে রাখলেও বেশকিছু ঘটনায় সরকারকে বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করে কোণঠাসা রাখতে সক্ষম হলেও তৃণমূলে দলীয় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা বা কিছু হাইব্রিড নেতার বেফাঁস ও অশালীন মন্তব্য নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনার ঝড় থামাতে গলদঘর্ম হতে হয় দলটির নীতিনির্ধারকদের। রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকলেও স্থানীয় সরকারের ভোট নিয়ে ছিল সরকারের চরম অস্বস্তি। ভোটার উপস্থিতি কম, খুনোখুনি, বিএনপির ভোট বর্জনসহ নানা কিছু ছিল আলোচনা-সমালোচনায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে শতাধিক নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পাশাপাশি নৌকার প্রার্থী মাত্র ৪২, ৬৯, ৯২ ভোট পাওয়ার মতো ঘটনা অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগের ভিতরে-বাইরে। সঠিক প্রার্থী মনোনয়ন নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে।

সর্বশেষ খবর