বৃহস্পতিবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

নারায়ণগঞ্জে ১০ ফ্যাক্টর

দল ও প্রতীকের বাইরেও অনেক মারপ্যাঁচ, চলছে নেপথ্যের হিসাব-নিকাশ

রোমান চৌধুরী সুমন ও এম এ শাহীন, নারায়ণগঞ্জ

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও বিএনপির সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতা তৈমূর আলম খন্দকারের ভাগ্য নির্ধারণে দল ও প্রতীকের বাইরেও রয়েছে অনেক মারপ্যাঁচ। কমপক্ষে ১০টি ফ্যাক্টর কাজ করছে ভোটের মাঠে। এসব ফ্যাক্টরকে নিজের দিকে আনতে নিজ নিজ শক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছেন প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী। প্রচারণা ও দলীয় কর্মকান্ডের বাইরে নেপথ্যের এই হিসাব-নিকাশ মিলাতে ব্যস্ততা রয়েছে দুই মহলই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভোটের আগ মুহূর্তে এই হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারে পুরো চিত্র। ১৬ জুনয়ারি এই সিটিতে ভোট গ্রহণ হবে।

নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণী ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে রয়েছে- ওসমান পরিবার সমর্থিত ভোট ব্যাংক; নারী ভোট; অঞ্চলভিত্তিক ভোট; তরুণ ভোট; হেফাজত-কওমি সমর্থিত ভোট; জামায়াত দলীয় ভোট; হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট; হকার-শ্রমিক; সরকারবিরোধী মনোভাব এবং দুই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী ওসমান পরিবার। এই পরিবারের দুই ভাই সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমান সিটি করপোরেশনের দুই এলাকার সংসদ সদস্য। বাণিজ্যিক সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের কমিটিগুলো ধারাবাহিকভাবেই এই পরিবারের সমর্থনপুষ্ট। স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এসব কারণে নারায়ণগঞ্জে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ হাজার ভোট প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে ওসমান পরিবারের। তাদের মতে, এই ভোট কোন প্রার্থীর দিকে যাবে তা এখনো দেখার বিষয়।

আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা জানান, নারায়ণগঞ্জের যে কোনো নির্বাচনে নারী ভোট একটি বড় ফ্যাক্টর। কারণ এই সিটির প্রায় অর্ধেক নারী ভোটার। সোয়া ৫ লাখ ভোটের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ ভোটার নারী। মেয়র পদে একজন নারী প্রার্থী থাকায় নারী ভোটারের সমর্থনের বিষয়টি বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। তার পরেও নারীদের ভোট কাটতে অন্য প্রার্থীও নানা কসরত করছেন। ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, দেশের শিল্প ও বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে ব্যবসায়িক কারণে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বসবাস। এ কারণে অঞ্চলভিত্তিক ভোটারদের প্রভাব রয়েছে যথেষ্ট। নারায়ণগঞ্জ সিটিতে মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও মাদারীপুরের ১ লাখের বেশি ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জেরই প্রায় অর্ধলাখ ভোটার; এর বাইরে কমপক্ষে ৩০ হাজার কুমিল্লার এবং প্রায় ২০ হাজার করে ভোটার রয়েছে চাঁদপুর ও মাদারীপুরের। এ ছাড়াও পাবনা ও নরসিংদীর বেশ কিছু ভোটার রয়েছেন। মেয়র পদে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর নজর এখন সেদিকে। এ জন্য তারা কাজে লাগাচ্ছেন আঞ্চলিক প্রভাবশালী ও ওই সব অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের।

ইসি সূত্রের তথ্য মতে, পাঁচ বছর আগের সিটি নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জে মোট ভোটার ছিল পৌনে ৫ লাখ। এবার সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সোয়া ৫ লাখে। প্রায় ৫০ হাজার তরুণ ভোটার যুক্ত হয়েছেন তালিকায়। নতুন এই তরুণ ভোটাররা মুখিয়ে আছেন নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আধুনিক মানসিকতার এই তরুণ ভোটাররা স্থানীয় ও জাতীয় সব ইস্যু বিবেচনায় নিয়েই যাবেন ভোট কেন্দ্রে। এই তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণে ডিজিটাল প্রচার মাধ্যমকে বেছে নিয়েছেন প্রার্থীরা। মসজিদ মাদরাসার নগরী নারায়ণগঞ্জে কওমি সমর্থিত ভোটারও রয়েছেন বেশ কিছু। ধারণা করা হয়, প্রায় ৩০ হাজারের মতো ভোটার রয়েছেন এই পন্থি। এরমধ্যে হেফাজতে ইসলামীর প্রতি সমর্থন বড় অংশের। কিছু সংখ্যক রয়েছেন চরমোনাই পীরের অনুসারী। নারায়ণগঞ্জ সিটিতে ইসলামী আন্দোলনের একজন মেয়র প্রার্থী থাকলেও হেফাজতের সরাসরি কোনো প্রার্থী নেই। তাই হেফাজতের সমর্থনকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকাশ্যে না হলেও নারায়ণগঞ্জে ৩০ থেকে ৪০ হাজার জামায়াত সমর্থিত ভোটব্যাংক রয়েছে বলে মনে করছেন প্রধান দুই প্রার্থীর নির্বাচনী কলাকৌশলীরা। বিএনপি সরাসরি ভোটে না থাকলেও জামায়াতের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক পুরনো ঐক্য রয়েছে। আবার ঐতিহ্যগতভাবেই জামায়াতপন্থিরা আওয়ামীবিরোধী। স্থানীয়রা বলছেন, সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই নারায়ণগঞ্জে অধিক সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। এখন কিছুটা কমে এলেও ভোটের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। তাই হিন্দু ভোটও নির্বাচনে ফ্যাক্টর। গার্মেন্ট, নীট ও টেক্সটাইলের নগরী নারায়ণগঞ্জের বন্দর এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক ভোটার রয়েছেন। এ ছাড়া সিটিজুড়েই রয়েছে হকার ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বসবাস। তারাও প্রয়োগ করবেন নিজেদের ভোটাধিকার।   

আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী সংগঠনের সভাপতি হাজী নূরউদ্দিন জানান, দুই মেয়র প্রার্থীর যে দলীয় কোন্দল রয়েছে তাতে যারা ধানের শীষ করেন তারা হয়তো হাতি মার্কায় ভোট দেবেন। কোন্দল যেটা আছে তাতে হয়তো স্বল্প সংখ্যক ভোট ফ্যাক্টর হতে পারে। ঠিক তেমনি নৌকার যে দলীয় কোন্দল রয়েছে তার বিবদমান দুটি পক্ষের একটি পক্ষ যদি চুপ থাকে তাহলে ভালো হবে। নইলে যারা নৌকায় ভোট দেওয়ার তারা নৌকায় ভোট দেবে। স্বল্প  স্যংখক ভোট হয়তো এপার ওপার হতে পারে। সরকারবিরোধী একটি মনোভাব দেশে আছে। তাতে নৌকার ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হলেও আইভীর একটি ব্যক্তি ইমেজ রয়েছে। তবে তার যে দোষ কিছু নেই তা কিন্তু না। মানুষ হিসেবে সবারই কিছু না কিছু দোষ থাকেই।

সর্বশেষ খবর