সোমবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ধারাবাহিকতায় আইভীর হ্যাটট্রিক

রোমান চৌধুরী সুমন ও এম এ শাহীন, নারায়ণগঞ্জ

সাড়ে ৬৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী। পরাজিত করেছেন সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে। এর মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আরও পাঁচ বছরের জন্য আইভীকেই বেছে নিল নারায়ণগঞ্জবাসী। ধারাবাহিকভাবে জয়ের হ্যাটট্রিক হলো সেলিনা হায়াৎ আইভীর।

গত রাতে বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী মোট ১৯২ কেন্দ্রে মেয়র পদে নৌকা প্রতীক পেয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৯৭ ভোট। অন্যদিকে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৬২ ভোট। তৃতীয় সর্বোচ্চ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের প্রার্থী মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ পেয়েছেন ২৩ হাজার ৯৮৭ ভোট। এ ছাড়া খেলাফত মজলিশের দেয়ালঘড়ি প্রতীকে এ বি এম সিরাজুল মামুন ১০ হাজার ৭২৪, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির হাতঘড়ি প্রতীকে মো. রাশেদ ফেরদৌস ১ হাজার ৯২৭, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের বটগাছ প্রতীকে মো. জসিম উদ্দীন ১ হাজার ৩০৯ এবং স্বতন্ত্র মো. কামরুল ইসলাম ঘোড়া প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১ হাজার ৩০৫ ভোট।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বেসরকারি এ ফলাফল ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোশেনে ইভিএমে ৫৬.২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। মেয়র এবং সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর মিলিয়ে এ নির্বাচনে মোট ১৮৯ জন প্রার্থী হলেও স্বাভাবিকভাবেই প্রচারের আলোয় ছিলেন চিকিৎসক আইভী ও আইনজীবী তৈমূর। জয়ী ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় আইভী টানা তিনবারের জয়ে নারায়ণগঞ্জবাসী, নেতা-কর্মী ও ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু আগামী পাঁচ বছর নয়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জবাসীর জন্য উৎসর্গ করে দেব। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে জনকল্যাণে কাজ করব।’ নিজেকে প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম খন্দকারের মেয়ের মতো উল্লেখ করে আইভী বলেন, ‘এ জয়কে তৈমূর আলম খন্দকারের মেয়ের জয়। আমি সিটি করপোরেশনের ভবিষ্যতের কর্মকান্ডে তৈমূর আলমকে নিয়েই কাজ করব। তার যেসব পরিকল্পনা আছে সেগুলোও বাস্তবায়ন করব।’ তিনি বলেন, ‘আমার নির্বাচনে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। সেসব চ্যালেঞ্জ জয় করেই নির্বাচনে জিততে হয়। জনসমর্থন না থাকলে আমি নারায়ণগঞ্জে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না।’ আইভী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেই আমাকে নৌকা প্রতীক দিয়েছেন। সেই বিশ্বাসের প্রতিদান হিসেবে আমি নারায়ণগঞ্জকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে আরেক দফায় প্রমাণ করতে পেরেছি।’ গতকাল বিকালে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর থেকেই আইভীর পশ্চিম দেওভোগের নিজ বাসভবন চুনকা কুটিরের আঙিনায় প্যান্ডেল সাজিয়ে প্রজেক্টরের মাধ্যমে বিভিন্ন কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রের ফলাফল লাইভে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ওই সময় কর্মী-সমর্থকরা একেক কেন্দ্রের জয়ের ঘোষণায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। ফলাফল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত আইভীর শহরের পশ্চিম দেওভোগে নিজ বাড়ি চুনকা কুটিরে ছিলেন। ছোট ছোট মিছিল নিয়ে তার বাসভবনে আসতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। সেখানে ছিল শুধুই উল্লাস। আইভী ও নৌকার নামে স্লোগানে মুখর ছিল এলাকা। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ছিল রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ের। সেখানে চূড়ান্ত বেসরকারি ফল ঘোষণা করার আগেই নৌকার সমর্থকদের মধ্যে শুরু হয় উল্লাস। নৌকার স্লোগানে মুখরিত হয় গোটা এলাকা। এ সময় ওই এলাকায় মুহুর্মুহু পটকা ফোটানোর শব্দ পাওয়া যায়।

এদিকে স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার শহরের মাসদাইর এলাকার নিজ বাসায় নিচতলায় বসে ভোট কেন্দ্রের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন। সন্ধ্যার পর আইভী জয়ের ফলাফলে এগিয়ে যাওয়ায় সুনসান ও আফসোসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেখানে কর্মী সমর্থকরা ছিলেন অনেকটা নীরব ও হতাশ। ফল ঘোষণার পর তৈমূর আলম বলেন, ‘ইভিএম কারচুপি ও প্রশাসনের লাগাতার গ্রেফতারের কারণে আমার এই পরাজয়। তবে এ পরাজয় আমার নয়, এ পরাজয় সরকারের।’ ভোটের আগে-পরের পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তৈমূর বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে আমার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশের আচরণ। সেটারই প্রমাণ হয়েছে।’ গ্রেফতার-হয়রানির অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে যারা ব্যস্ত ছিলেন, তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে আওয়ামী লীগের লোক আসার পর থেকে আমার নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু হয়। এ অবস্থায় একজন মানুষ স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে কীভাবে ঠিক থাকতে পারে?’

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন গঠনের পর প্রথমবার ২০১১ সালে সিটি করপোরেশনের নির্দলীয় নির্বাচনে সেলিনা হায়াৎ আইভী ১ লাখ ১ হাজার ৩৪৩ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন নিজ দলেরই আরেক প্রার্থী শামীম ওসমানকে। ওই নির্বাচনে শেষ মুহূর্তে নির্বাচন থেকে সড়ে যাওয়া বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার পান সাড়ে ৭ হাজার ভোট। পরের বার ২০১৬ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে সেলিনা হায়াৎ আইভী ৭৯ হাজার ৫৬৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে। এবারও বিএনপির পরোক্ষ প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারকে পরাজিত করলেন ৬৯ হাজার ১০২ ভোটে।

সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাবা আলী আহাম্মদ চুনকা ছিলেন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ১৯৬৬ সালে জন্ম নেওয়া আইভী পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। রাশিয়ার ওডেসা পিগারভ মেডিকেল ইনস্টিটিউটে তিনি ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রি নেন। এরপর উচ্চতর পড়াশোনা করতে যান নিউজিল্যান্ডে। সেখান থেকে ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে প্রথম নারী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তিনি। এর পর থেকে টানা ১৮ বছর পৌরসভা এবং পরে রূপান্তরিত সিটি করপোরেশনের কান্ডারি হিসেবে রয়েছেন আইভী। নগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শুরু করা আইভী এখন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি।

সর্বশেষ খবর