রবিবার, ২৩ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

শাহজালালে কাফন মিছিল

সমস্যার সমাধান হয়নি শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকেও, অনশনে থাকা ১৬ শিক্ষার্থী হাসপাতালে

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা-সিলেট ও শাবি প্রতিনিধি

শাহজালালে কাফন মিছিল

উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে কাফনের কাপড় পরে মিছিল করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে কাফন মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। অনশন, মশাল মিছিলের পর গতকাল প্রতীকী কফিন কাঁধে নিয়ে কাফনের কাপড় পরে মিছিল করেছেন আন্দোলনকারীরা। অন্যদিকে অনশনরত শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থা ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। গতকাল সন্ধ্যা অবধি ১৬ জন ভর্তি ছিলেন হাসপাতালে। টানা ১০ দিনেও বিশ্ববিদ্যালয়ের   অচলাবস্থা উত্তরণে কোনো আলামত নেই। গত ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের ছাত্রীরা। পরদিন তাদের আন্দোলনে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। এরপর একের পর এক কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এ আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি)। এদিকে গত রাতে ঢাকায় শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষকদের বৈঠক হয়েছে। শাবি শিক্ষক প্রতিনিধির সঙ্গে ওই বৈঠকেও সমস্যা সমাধান হয়নি।

সরেজমিন দেখা গেছে, গতকাল বিকাল ৩টায় প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী শাবি ক্যাম্পাসের গোলচত্বরে অবস্থান নেন। সেখান থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে কাফনের কাপড় পরে স্ট্রেচারে প্রতীকী লাশ নিয়ে মৌন মিছিল বের করেন তারা। মিছিলটি গোলচত্বর হয়ে চেতনা একাত্তর ভাস্কর্য এলাকা প্রদক্ষিণ করে ফের গোলচত্বরে অবস্থান নেয়। সেখানে প্রতীকী লাশ সামনে রেখে অবস্থান করেন তারা। মৌন মিছিলে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী সাদিয়া আফরিন বলেন, ‘আমাদের এক দফা এক দাবি। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে গত বৃহস্পতিবার ২৪ জন শিক্ষার্থী অনশনে বসেন। প্রায় ৭৪ ঘণ্টা পার হলেও আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়নি। তাদের স্বাস্থ্য ক্রমাগত অবনতি ও মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা আমাদের সহযোদ্ধাদের কোনোভাবেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারি না। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন আমাদের এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলনের মঞ্চ থেকে এক-পাও নড়ব না। এই উপাচার্যের জন্য যদি একজনেরও মৃত্যু হয়, তাহলে আমরা সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত আছি।’

হাসপাতালে ১৬ জন, শঙ্কা : শাবিতে অনশনরত ২৪ শিক্ষার্থীর মধ্যে একজনের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি বাড়ি চলে গেছেন। বাকি ২৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৬ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। রক্তচাপ কমে যাওয়া ও অস্বাভাবিক ওঠানামা, জ্বর, সর্দি, কাঁশি, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অনশনরত প্রত্যেককেই স্যালাইন প্রদান করা হচ্ছে।

বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে না যাওয়ার আহ্বান : বহিরাগত কাউকে শাবি ক্যাম্পাসে না যেতে আহ্বান জানিয়েছেন প্রক্টর ড. আলমগীর কবির। তিনি বলেন, করোনার সংক্রমণ বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বাইরের কেউ যাতে শাবি ক্যাম্পাসে ঘুরতে না যান।

ঢাবিতে অবস্থান কর্মসূচি : শাবি শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষার্থী। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি পালন করেন তারা।

কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ হাসান বলেন, আমাদের ভাই-বোনেরা অনশনে পথের ধারে মৃত্যুঝুঁকিতে কাতরাচ্ছে। কিন্তু স্বৈরাচারী ভিসি ঠিকই তার অবস্থানে অনড়। ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আরাফাত সাদ বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংহতি জানিয়ে আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

আন্দোলনকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর : শাবি শিক্ষার্থীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গত রাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে হেয়ার রোডের বাসায় গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। মন্ত্রী বলেন, এর আগে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। তারা বলেছিলেন, যেখানে ইচ্ছা এসে আমার সঙ্গে কথা বলবেন। তারা খুব উৎসাহ দেখিয়েছিলেন। পরে তারা জানান, আন্দোলনকারীরা আসতে চান না, ভার্চুয়ালি কথা বলতে চান। কিন্তু আমি পারিবারিক অসুস্থতার কারণে এ মুহূর্তে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারছি না। শিক্ষার্থীদের জন্য আলোচনার পথ খোলা আছে। মন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের যে কোনো দাবি থাকলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিষ্পন্ন হওয়ার রাস্তা রয়েছে।

কিন্তু এখন একটি ভিন্ন দাবি এসেছে। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারীদের দাবি যৌক্তিক কি না সে ব্যাপারেও আলোচনার প্রয়োজন আছে। তিনি বলেন, শাবিপ্রবি গত চার বছর খুব ভালোভাবে চলেছে। সম্প্রতি আন্দোলনে পুলিশি অ্যাকশনের কারণে শিক্ষার্থীরা আহত হয়েছেন। আমরা এটি চাই না।  সেখানে শিক্ষার্থীরা অনশন করছেন। এটি কারও ভালো লাগার কথা নয়। যারা অনশনরত আছেন আশা করছি তারা দ্রুত অনশন শেষ করবেন। চলমান আন্দোলনে কারও ইন্ধন আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে গণমাধ্যমকর্মীদের অনুরোধ করেন মন্ত্রী।

গণঅনশনে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা : আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র ইয়াসির সরকার বলেন, শাবি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে ৭৪ ঘণ্টা টানা অনশন করে শিক্ষার্থীরা যখন মৃত্যুপথযাত্রী, তখনো ফরিদ উদ্দিন আহমেদ নির্বিকার। এমন পরিস্থতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে দেখে গণঅনশনে বসার সংকল্প নিয়েছে।

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়া : ঢাকায় শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পর আন্দোলনকারীদের পক্ষে গত রাত ৯টায় ইয়াসির সরকার ও মোহাইমিনুল বাশার রাজ প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই আন্দোলনে বাইরের কেউ ইন্ধন দিচ্ছে না। আমরা এখনো আলোচনায় রাজি। ঢাকা থেকে প্রতিনিধি দল ক্যাম্পাসে এসে কিংবা ভার্চুয়ালি আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত : ভর্তি কমিটির সদস্যসচিব চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল হোসাইনী জানান, অনিবার্য কারণবশত আগামী ২৫ ও ২৬ জানুয়ারি প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টার ২০২০-২০২১-এর ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। ভর্তির পরবর্তী নির্দেশনা ও তারিখ যথাসময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রভোস্ট ও প্রভোস্ট বডির পদত্যাগের দাবি এবং হলের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন হলের ছাত্রীরা। পরদিন তাদের আন্দোলনে অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাংশ। আন্দোলনের মুখে গত ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। তাকে মুক্ত করতে গিয়ে সাউন্ড গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ও শিক্ষার্থীদের ওপর রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ। এরপর শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন।

গত বুধবার বিকাল থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে ২৪ জন শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করেন। এরপর তাদের সঙ্গে অনশনে যোগ দেন আরও কয়েকজন। গতকাল রাত ৮টা পর্যন্ত অনশনরত ১৬ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর