শিরোনাম
শুক্রবার, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বাংলার জন্য আরেকবার পথে নামি

মোহন রায়হান

বাংলার জন্য আরেকবার পথে নামি

ভাষা যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ভাষাই জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করে। বাংলা ভাষায় কথা বলি বলেই বাঙালি হিসেবে বিশ্ব দরবারে আমাদের পরিচয়। ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়া জাতি কটিই বা আছে বিশ্বে? কিন্তু যে লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যে বাঙালি ভাষা আন্দোলন এবং জীবন উৎসর্গ করেছিল তা কি সর্বাংশে সফল হয়েছে নাকি কালের রথ উল্টোপথে চলছে? ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের অঙ্গীকার, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের ১৭ দফার ১ নম্বর দাবি রাষ্ট্রভাষা বাংলা, ১০ নম্বর দাবি মাতৃভাষায় শিক্ষা দান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। অর্থাৎ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা। এমনকি স্বৈরশাসক এরশাদের আমলেও ’৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন জাতীয় সংসদে পাস হয়। এই আইনে বলা হয়, বিদেশে যোগাযোগ ব্যতীত বাংলাদেশের সর্বত্র, সব প্রতিষ্ঠানে, সর্বক্ষেত্রে এমনকি আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনি কার্যকলাপ অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে। যদি কোনো কর্মস্থলে কোনো ব্যক্তি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করে তবে তা অকার্যকর ও বেআইনি বলে বিবেচিত হবে। কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী যদি এই আইন অমান্য করেন তাহলে তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও বিধি ভঙ্গকারী হিসেবে তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি এবং প্রতিনিয়ত এই আইন অমান্যের জন্য কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

একটি রিটের কারণে ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বর প্লেট, সরকারি দফতরের নাম ফলক, গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেন। অতঃপর সরকারি কাজে নামমাত্র বাংলা ভাষার প্রচলন হলেও প্রকৃত অর্থে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। বরং নতুনভাবে আবার বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের গভীর ষড়যন্ত্র চলছে চারদিকে ইংরেজি ভাষার ছড়াছড়িতে। বাঙালির সর্বকালীন, সর্বজনীন, মাতৃভাষা কেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার দাবির পরিবর্তে বিজাতীয়, বিভাষীয়, শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ আকর্ষণ তৈরিতেই পরোক্ষ ইন্ধন জুগিয়েছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং শাসক শ্রেণি। মাতৃভাষা, নিজস্ব শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টির প্রতি গভীর একাত্মতা, অনুরাগ তথা দেশপ্রেমের চেয়ে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা, অর্থ, বিত্তবৈভবের প্রতি দুর্দম আকর্ষণ তৈরি এবং তার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা এবং বিদেশ গমনই প্রধান উপায় হিসেবে দেশের মূল সম্পদ যুবশক্তির কাছে উপস্থিত করা হয়েছে নির্লজ্জভাবে। শাসক শ্রেণি জনদাবির কারণে বক্তৃতায় বলুক আর জাতীয় সংসদে আইন পাস করেই বলুক বাস্তবে তারা তা করেনি তাদের শ্রেণি চেতনা এবং বুর্জোয়া আদর্শিক, মনস্তাত্ত্বিক কারণে। তার বাস্তব প্রমাণ মিলছে তাদের নিঃশঙ্ক লুটপাট, দুর্নীতির টাকা এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের বিদেশে পাচার, আর সেখানেই স্থিত হওয়ার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্নের সাম্প্রতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে।

এখন উদ্ধারের উপায় কী? সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন বা রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার? ৭০ বছর পর একই দাবি? হ্যাঁ, কাউকে না কাউকে তো শুরু করতেই হবে। হ্যাঁ, একজন শুরু করেছেন। চট্টগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা। যারা ‘জয় বাংলা’, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইদ্যাদি স্লোগান দিয়েছিলেন, যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ-এর, যারা এখনো বিশ্বাস করেন সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা’ তথা স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে- তাদেরই একজন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবিতে ৭৪ বছর বয়সে পথে নেমেছেন যুবক, বৃদ্ধ নরনারীকে সঙ্গে নিয়ে। ৬০-এর দশকের মতন পথে পথে ঘুরে আইন অনুযায়ী প্রতিটি সাইনবোর্ডের প্রধান ৬০% বাংলায় এবং বাকি ৪০% যে কোনো ভাষায় লিখতে বাধ্য করছেন। দাবি তুলেছেন সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলা কায়েমের জন্য। দাবির পক্ষে এমন জোরালো বক্তব্য, যুক্তি, সাংবিধানিক আইনি সাক্ষ্য-প্রমাণ, দলিল হাজির করেছেন যে, স্বয়ং মেয়র, জেলা প্রশাসক, সরকার দলীয়সহ কেউই অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান তো দূরের কথা বরং তাঁদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, তাঁদের দাবি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছেন। আমার ধারণা এ দাবি ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে এবং তা বাস্তবায়নও সম্ভব।

মহান ভাষার মাসে আসুন, ডা. মাহফুজুর রহমান এবং তাঁদের ‘বাংলা ভাষা প্রচলন উদ্যোগ’-এর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরাও পথে নামি। আমরাও মেয়র মহোদয়গণ, জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সমর্থনে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ৬০% বাংলার প্রাধান্য দিয়ে লেখার এবং সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, কবি, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীসহ দেশপ্রেমিক জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আর ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্মান আর কোটি কোটি মানুষের অশ্রু, দীর্ঘশ্বাস, দুঃখ-কষ্ট, অবর্ণনীয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য আরেকবার পথে নামি। মন-প্রাণ, আত্মা জুড়ানো ‘মা’ ডাক উচ্চারণের জন্য। হৃদয়ের গহিন গভীর থেকে সমস্ত দরদ উজাড় করে বলে উঠি-‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা!।’

সর্বশেষ খবর