মঙ্গলবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত

শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে মানুষের ঢল

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক

শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে মানুষের ঢল

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গতকাল শ্রদ্ধা জানান বিদেশি কূটনীতিকরাও -বাংলাদেশ প্রতিদিন

অমর একুশকে শ্রদ্ধা নিবেদনে গতকাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মিলন ঘটেছিল ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে সব মত ও পথের মানুষের। হাতে হাতে ফুল, কণ্ঠে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ ধারণ করে জনস্রোত নেমেছিল মিনারে। তারা দৃপ্ত শপথ নিয়েছেন শহীদদের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে।

জেলা-উপজেলাসহ সারা দেশে এদিন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে মহান ভাষাশহীদদের। প্রতিবারের মতো এবারও ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। একুশের প্রথম প্রহরে এবং দিনের আলোয় স্মৃতির মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এদিন ভাই হারানোর শোক প্রকাশে কালো রঙের প্রাধান্য ছিল পোশাকে। মায়ের ভাষার জন্য আত্মত্যাগ ও অর্জনের আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসা মানুষ বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষার মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনেরও দাবি জানান।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন উপলক্ষে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশের প্রথম প্রহরেই হাজার হাজার মানুষ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে বাঙালির শোক আর অহংকারের এই মিনার। মহামারির বাস্তবতায় গত বছরের মতো এবারও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের পর্বটি হয়েছে সীমিত পরিসরে। প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের তরফ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় পর্ব। মহামারির মধ্যে গত বছরের মতো এবারও তাদের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তাদের সামরিক সচিবরা।

রাষ্ট্রপতির পক্ষে ফুল দেন তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম। আর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানায় সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার পক্ষে সহকারী সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস গোলাম শাহরিয়ার তালুকদার পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এরপর তিন বাহিনীর প্রধানদের মধ্যে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের পক্ষে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন ইকবাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুুল হান্নান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ সময় অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ ধ্বনিত হতে থাকে। তারা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর পক্ষে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ, শাজাহান খান ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-দফতর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির পক্ষে দলের মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ১৪ দলের পক্ষে ডা. দীপু মনি ও হাসানুল হক ইনু ফুল দেন শহীদ বেদিতে।

প্রথম প্রহরেই পুলিশের পক্ষে আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুুল্লাহ আল মামুন, ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঢাকা সিটি করপোরেশনের দুই মেয়রের পক্ষে তাদের প্রতিনিধিরা শ্রদ্ধা জানান। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের পক্ষে জাতীয় পার্টির নেতা মুজিবুল হক চুন্নু ও অন্য নেতারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। একুশের প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের পক্ষে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. রহমত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সভাপতি এ কে আজাদের নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন।

সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ও বাড়তে থাকে শহীদ মিনার এলাকায়। পরে শহীদ মিনারের বেদি জনসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তখন একে একে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সর্বস্তরের মানুষ শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে থাকেন।

কেন্দ্রীয় ১৪ দলের পক্ষে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনিসহ অন্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলীয় নেতা-কর্মীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে তারা আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। সকালে আওয়ামী লীগের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান দলটির নেতারা। এ সময় প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান ও আবদুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহা উদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও আফজাল হোসেন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, সংস্কৃতি সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন, উপদফতর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান জিন্নার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেস ক্লাব, সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরাম, গণফোরাম, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ, ছাত্রলীগ, আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, গণতন্ত্রী পার্টি, আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মুজিববর্ষ উদযাপন কমিটির সমন্বয়ক কামাল উদ্দিন নাসের, বাংলাদেশ টেলিভিশন, গণপূর্ত অধিদফতর, বাম ঐক্যফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ জনসেবা পার্টি (বাজপা) এবং অন্যান্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায়। সকাল নাগাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল প্রশাসনের পক্ষেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। 

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল সকাল সাড়ে ৬টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে সীমিত পরিসরে একটি প্রভাতফেরি অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়। প্রভাতফেরি সহকারে তাঁরা আজিমপুর কবরস্থানে গমন করেন এবং ভাষাশহীদদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর ভাষাশহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ করা হয়। পরে প্রভাতফেরি সহকারে তাঁরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গমন করেন এবং পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। বাদ জোহর মসজিদুল জামিয়াসহ সব হলের মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার মসজিদে ভাষাশহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এ ছাড়া, অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আগের দিন রবিবার সন্ধ্যা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ডিএমপির পক্ষ থেকে নেওয়া হয় ছয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ইউনিফরম পুলিশের পাশাপাশি কাজ করেছে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা পুলিশ। বসানো হয়, আর্চওয়ে ও ওয়াচ টাওয়ার। পলাশী মোড় হয়ে কয়েক ধাপের নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে ফুল দিতে যেতে হয় মানুষকে। তবে ব্যক্তি পর্যায়ে সর্বোচ্চ দুই জন ও সংগঠন পর্যায়ে সর্বোচ্চ পাঁচজন একসঙ্গে শ্রদ্ধা জানাতে পারবে- এমন কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত তার কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। এমনকি শ্রদ্ধা জানাতে এসে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর