রবিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত

সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে

মেজর নাসির উদ্দিন আহাম্মেদ (অব.)

দেখতে দেখতে বেধেই গেল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। দ্রুতই বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট। যে প্রেক্ষাপটে এই লেখাটা শুরু করছি, সে সময় থেকে সুপ্রিয় পাঠক যখন লেখাটা পড়ছেন, এটুকু সময়ের মধ্যে বদলে যাবে অনেক কিছু। মৃত্যুর সংখ্যা, উদ্বাস্তুর সংখ্যা, বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ কিংবা হাসপাতালে আহত রোগীর সংখ্যা জ্যামিতিকহারেই হয়তোবা বাড়বে। অলৌকিক কিছু না ঘটলে হুট করেই এই অসম যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে, এমনটা প্রত্যাশা করার মানুষ দ্রুতই কমছে।

সর্বশেষ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ (শুক্রবার) রাতে রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে রাশিয়ার পরম ক্ষমতাশালী প্রেসিডেন্ট তথা বিশ্বের প্রথম তিন ক্ষমতাশীল ব্যক্তির একজন ভøাদিমির পুতিন যুদ্ধ এড়াতে কিংবা সমঝোতার লক্ষ্যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা নিতে বললেন। সেই সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের জোট আটলান্টিক ট্রিটিস অর্গানাইজেশনে (ন্যাটো) রাশিয়ার আপত্তির মুখে ইউক্রেনের যোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে মূলত এই যুদ্ধের সূত্রপাত বলে বিশ্ববাসীর ধারণা সত্ত্বেও ন্যাটোতে যোগ দিলে ফিনল্যান্ড কিংবা সুইডেনের অবস্থাও ইউক্রেনের হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ক্রেমলিন। এর মধ্য দিয়ে পুতিন যেন প্রকাশ্যেই ঘোষণা করলেন যে, যুদ্ধ তো বর্তমান ইউক্রেন নয়, যুদ্ধটা মূলত রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর। আর বর্তমান দিনে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি এবং বিশ্ব অর্থনীতির মোড়ল খ্যাত চায়না রয়েছে রাশিয়ার পক্ষে। শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) পুতিনের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে চায়নার প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ কিংবা সহায়তার কথা ঘোষণা করেন। চীনের এই উদ্যোগকে কেউ কেউ শান্তির পরশ মনে করলেও ন্যাটো তথা আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বকে এক প্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই চীন ইউক্রেনে রাশিয়ার সৈন্যদের এই উপস্থিতিকে সামরিক অভিযান বলতে কিংবা এ জন্য রাশিয়াকে ধিক্কার দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে যুদ্ধটা ন্যাটো বনাম রাশিয়া-চীন মিত্রের সংঘাত অথবা আরও মোটা দাগে আমেরিকা বনাম আমেরিকাবিরোধীদের যুদ্ধে রূপ নেওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এর বিপরীতে চীনের বিচক্ষণতার দিকেও তাকিয়ে আছে বিশ্বের একটা অংশ। কারণ রাশিয়া, ইউক্রেন, আমেরিকাসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রয়েছে হালের ‘টাকার দৈত্য’ খ্যাত চীনের পণ্য ও ঋণের সরব উপস্থিতি। যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে তেলের মূল্যবৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস, যুদ্ধ ব্যয় মিটাতে উন্নয়ন ব্যয় হ্রাস ও ট্যাক্স বৃদ্ধি, সর্বোপরি সমুদ্রপথে যোগাযোগ বা পণ্য পরিবহনে নানাবিধ জটিলতা এই সত্য চীন যথাথই অনুধাবন করে। ফলে একটি শান্ত সমুদ্রে তথা অবাধ বাণিজ্য ও ঋণের বিপরীতে নিজ পণ্য এবং নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিশ্বময় কর্তৃত্বের পরিবেশ বজায় রাখতে যুদ্ধআক্রান্ত বিশ্বের বদলে দ্রুত ধাবমান অর্থনীতির বিশ্বের প্রতি চীনের নজর প্রত্যাশা করছে শান্তিকামী মানুষ। চীন প্রদত্ত ঋণ ফেরত পাওয়াটাও শান্তিময় ও উন্নয়নশীল বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল।

রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি আবারও জাতিসংঘের মৌলিক শক্তির অভাব ও সীমাবদ্ধতাকে পাদপ্রান্তে তুলে এনেছে। জাতিসংঘ এবং আমেরিকা যৌথভাবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণকে নিন্দা জানিয়ে ও অবিলম্বে রাশিয়ার সৈন্যদের প্রত্যাহার দাবি করে একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছেন। যার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই (শুক্রবার) ভেটো দিয়ে তা নাকচ করেছে রাশিয়া। ভোট প্রদানে অনুপস্থিত থেকে রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দিয়েছে চীন। ফলে জাতিসংঘ স্বীকৃত পঞ্চপা-বের মধ্যে একদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের বিপরীতে রইল রাশিয়া ও চীন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উপরোক্ত পাঁচটি স্থায়ী সদস্যের পাশাপাশি রয়েছে ১৫টি অস্থায়ী সদস্য দেশ। এই ১৫টি দেশের মধ্যে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকে। এ বিষয়টি ভাবিয়ে তুলবে ভারতের পার্শ¦বর্তী দেশগুলোসহ ভারত মহাসাগরকেন্দ্রিক সমুদ্রপথে চলাচলে নিয়োজিত দেশগুলোকে। আমেরিকার প্রস্তাবকে সমর্থন না দেওয়ার অর্থই হলো ভারত আমেরিকা নয়, চীন-রাশিয়ার পক্ষে। বিষয়টা দীর্ঘদিন মনে রাখবে আমেরিকা। ফলে ভারত কিংবা মোদি প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলতে পিছপা হবে না আমেরিকা। আর এ কাজে ভারতের পেটে থাকার মতো বাংলাদেশের ভূখন্ড, সরকার জনগণ কিংবা গোয়েন্দা ও সীমান্ত বাহিনীকে কাজে লাগাতে চাইবে আমেরিকা। এখানেই সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশে ভারত, চীন ও রাশিয়ার বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। ভারতীয় বিশাল দক্ষ জনশক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি খ্যাত তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী বিপণন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত। রাশিয়া বাংলাদেশের রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে অনেক দূর এগিয়েছে। ‘সাশ্রয়ী মূল্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার প্রত্যাশায় দিন গুনছে দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারীরা। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কাঁচামাল ও চরম ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক আবর্জনার নিরাপদ ব্যবস্থাপনার জন্য রাশিয়াকে বাংলাদেশের পাশে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদে। বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে গম, শিশুখাদ্য, খনিজ পদার্থ, রাসায়নিক দ্রব্য, প্লাস্টিক পণ্য, ধাতব পদার্থ ও যন্ত্রপাতি আমদানি করে থাকে। আর রপ্তানি করে তৈরি পোশাক, পাট, হিমায়িত খাদ্য, চা-পাতা, চামড়া, হোম টেক্সটাইল ও সিরামিক পণ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত ও রাশিয়ার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য বিশেষত চাল, ডাল, গম (আটা, ময়দা), পেঁয়াজ  প্রভৃতি ভারতনির্ভর। সুতরাং চীন, রাশিয়া ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাবের কর্মকান্ডের সূত্রে ছয় কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তি-পাল্টাযুক্তি, সবশেষ বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক আমেরিকার জনসংযোগ ও লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ প্রমাণ করে আমাদের পাশে আমেরিকার আবশ্যিকতা। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবেশের দুটি সিংহদ্বার হলো আমেরিকা ও ইউরোপে আমেরিকার মিত্র দেশগুলোতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিজনিত আয় এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের বেতন এবং অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ভাড়াজনিত আয়। উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ মার্কিন ডলারে অর্থ পায় বলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মূলত আমেরিকাকেন্দ্রিক। জাতিসংঘ মিশন বন্ধের মিথ্যা গল্প শুনিয়ে এক-এগারোর কুশীলব মেজর জেনারেল মইন ইউ আহাম্মেদ (অব.) (প্রাক্তন সেনাবাহিনী) প্রথম দুই বছরের জন্য বাংলাদেশে অ™ভুত এক ‘সেনাসমর্থিত’ সরকার প্রবর্তন করেছিলেন। সে স্মৃতি আমাদের নীতিনির্ধারকদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সব মিলিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশকে।

সরকারের সামনে এ যেমন এক এসিড টেস্ট, দেশের মানুষের সামনেও এ এক ক্রান্তিকাল। যে কোনো কারণে যদি যুদ্ধ ব্যাপকতা লাভ করে, তবে এরই মধ্যে বেড়ে যাওয়া জ্বালানির দাম আরও বাড়বে। তারচেয়ে বড় শঙ্কা কোনো কারণে যুদ্ধটা ভারত মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়লে বা সাগর-মহাসাগরে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে জ্বালানি আমদানিসহ দেশের সব আমদানি ও রপ্তানি চরম ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে একদিকে উৎপাদন ব্যাহত এবং অন্যদিকে রপ্তানিতে মন্দা দেখা দিতে বাধ্য। একশ্রেণির লোভী মানুষ এ সময় অযৌক্তিকভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে  জনগণকে বেকায়দায় ফেলে নিজেরা লাভবান হয়। তারা আবার সরকার সমর্থক পরিচয় দিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটালেও দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে সরকারকেই বিব্রত করে। তবে নতুন করে আমাদের একে একে অনেক ধরনের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হবে। রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান কোনো শুভ লক্ষণ নয়। আবার এক-এগারোর কুশীলব বিশেষত এক মেজর জেনারেল ও দুই ব্রিগেডিয়ারের আমেরিকায় পুনর্বাসন প্রমাণ করে আমেরিকা মুখে গণতন্ত্রের যত বুলিই ঝাড়ুক, নিজ স্বার্থে তার কাছে সবই পূতপবিত্র। আমাদের ছোট্ট ভূখন্ডে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি আশীর্বাদের পাশাপাশি বিশাল নিরাপত্তা হুমকি। ভারত থেকে গম, চাল ও পেঁয়াজ এবং চীন থেকে আদা, রসুন ও গাজর আমদানির বদলে নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া আদৌ অসম্ভব নয়, কিন্তু আমরা তা করছি কোথায়? কৃষক আলু উৎপাদন করে নিজের খরচও তুলতে পারে না। অথচ আলু রপ্তানি করে সমৃদ্ধ পৃথিবীর বহু দেশ। একেক যুদ্ধ একেকটি শিক্ষা দেয়। জাপান, কোরিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর বহু দেশ যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়েই ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমরাও পারব, প্রয়োজন সরকার ও জনগণের বিচক্ষণতা।

লেখক  : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর