বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ভেজাল মদে সয়লাব নগর

বাড়ছে মৃত্যু, কারখানা গড়ে তুলে হচ্ছে উৎপাদন

সাখাওয়াত কাওসার

ভেজাল মদে সয়লাব নগর

ভেজাল মদ খেয়ে ২৪ নভেম্বর মারা যান রাজধানীর পিংক সিটি এলাকার বাসিন্দা কামরান আহমেদ। তিনি ছিলেন তুরস্কের নাগরিক এবং বিদেশি একটি কোম্পানির বাংলাদেশি কান্ট্রি ম্যানেজার। সেই মদ কামরান তার এক বন্ধুর মাধ্যমে গুলশানের একটি বার থেকে আনিয়েছিলেন। সন্ধ্যার দিকে মদ পান করার আধা ঘণ্টার মধ্যেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনরা। পরে রাত ৩টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, কামরানের রক্তে মিথাইল অ্যালকোহলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সর্বশেষ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।

গত বছরের ২৮ জানুয়ারি বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকের পিআর প্রতিষ্ঠান  ফোরথটপিআরের ৪৩ জন কর্মী গাজীপুরের সারাহ রিসোর্টে অবকাশ কাটাতে যান। সেখানে মদ পান করে ঢাকায় ফেরার পর মারা যান তিনজন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় আরও বেশ কয়েকজনকে। একই বছরের ৩১ জানুয়ারি রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী মারা যান। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে পুলিশের দাবি, ওই ছাত্রী ২৮ জানুয়ারি উত্তরার একটি রেস্তোরাঁয় মদ পান করেন। তাদের মধ্যে এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে ৩০ জানুয়ারি সিটি হাসপাতালে মারা যান। এর পরদিন মারা যান ওই ছাত্রী।

এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটলেও গণমাধ্যমে উঠে আসেনি। সমালোচনা এড়াতে এসব ঘটনার বেশির ভাগই চেপে যাচ্ছে ভুক্তভোগী পরিবার। বেসরকারি হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, পুলিশসহ অন্যান্য ঝামেলা এড়াতে মদ খেয়ে অসুস্থরা সাধারণত হাসপাতাল এড়িয়ে চলতে চান। পরিস্থিতি গুরুতর হলেই কেবল তারা হাসপাতালে আসেন। এ ক্ষেত্রেও বেশির ভাগই সরকারি হাসপাতাল বেছে নেন। তবে এসব ঘটনায় ভেজাল মদের ভয়াবহতা নিয়ে  তৈরি হয়েছে ব্যাপক উদ্বেগ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে নানা তথ্য।

ভেজাল মদের ভয়াবহতার বিবরণ উল্লেখ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, বিষাক্ত মদে কিডনি ও লিভার সমস্যা দেখা দিতে পারে। ভেজাল মদে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এ ছাড়া স্নায়ুতন্ত্রেও মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। খাওয়ার অনুপযোগী মিথানল শরীরে প্রবেশ করলে বিষক্রিয়ায় কোষে অক্সিজেন সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরে অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং কিডনি সেই অতিরিক্ত অ্যাসিড বের করে দিতে সক্ষম হয় না। এ কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, প্রচ- বমি হতে থাকে, দম বন্ধ হয়ে আসে। এক পর্যায়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। মিথানল গ্রহণ করার পর যত সময় যায়, ততই তা শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। ফলে শরীরের আরও বেশি ক্ষতি হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) মহাপরিচালক আবদুস সবুর মন্ডল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মদে ভেজাল অত্যন্ত ভয়ংকর ঘটনা। ব্র্যান্ডেড মদের ক্ষেত্রে কপিও বড় ধরনের অপরাধ। বিষয়টি এনবিআরকে আমরা অবহিত করব। এনবিআর এসব বিষয়ে যথেষ্ট সিরিয়াস। প্রয়োজনে এনবিআর এবং ডিএনসি যৌথ অভিযানে নামবে।’

ডিএনসি সূত্র বলছে, বিদেশি মদের সংকটে অনেকেই এখান-সেখান থেকে নিম্নমানের খোলা মদ কিনে খাচ্ছেন। এ সুযোগে কয়েকটি সংঘবদ্ধ চক্র বিপুল পরিমাণ ভেজাল মদ বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছে। গত ২৫ ডিসেম্বর পাবনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিএনসি একটি প্রতিবেদন  তৈরি করে। এর ভিত্তিতে ঢাকা মেট্রো (উত্তর-দক্ষিণ) ও কয়েকটি জেলা অফিসে চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি। ১৫ ডিসেম্বর ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উত্তর ও দক্ষিণের উপ-পরিচালক বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, থার্টিফার্স্ট নাইট ঘিরে অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীরা ভেজাল মদ তৈরি করে বাজারজাত করতে পারে। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রণে ত্রুটির কারণে তা বিষাক্ত হয়ে প্রাণহানি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ ও এলিট ফোর্স র‌্যাবও তাদের নজরদারি বাড়ায়। ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক মো. ফজলুর রহমান বলেন, বিদেশি মদের অবৈধ বেচাকেনা বন্ধে তারা বিশেষ তৎপরতা চালাচ্ছেন। ফলে বেশ কয়েক মাস ধরে বাজারে এর সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগে অসাধু চক্র ভেজাল মদ বানিয়ে বাজারে সরবরাহ করতে পারে- তারা এ ধরনের গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছেন। গত থার্টিফার্স্ট নাইট ঘিরে ঢাকা মেট্রো উত্তর ও দক্ষিণে চারটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

জানা গেছে, সীমান্তের বিভিন্ন চোরাইপথে ভারতীয় মদ বাংলাদেশে আসছে। প্রায়ই তাদের হাতে এসব মদের ছোট-বড় চালান ধরা পড়েছে। তবে তা আসল নাকি ভেজাল, তা তাদের জানা নেই। সম্প্রতি ভারতের খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা আনন্দবাজারের বাংলাদেশে ভেজাল মদ পাচার-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ভারতের শুল্ক গোয়েন্দারা নদীয়ার করিমপুরে একটি ভেজাল মদের কারখানার সন্ধান পেয়েছেন। সেখান থেকে বিপুল ভেজাল মদ তৈরির উপকরণ উদ্ধার করা হয়। এসব মদের একটি অংশ ভারতের বিহার ও ঝাড়খন্ডে পাঠানো হলেও এর বড় অংশ বাংলাদেশে পাচার হয়। এসব মদের চালান সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ছে বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ওই প্রতিবেদনে আরও দাবি করা হয়, ক্যারামেলের (চিনি পুড়িয়ে তৈরি করা রস) সঙ্গে রয়্যাল স্ট্যাগের মতো সস্তা দরের হুইস্কি, কখনোবা পানি মেশানো স্পিরিট দিয়ে সেখানে জ্যাক ড্যানিয়েল, শিবাস রিগ্যাল ও ব্ল্যাক লেবেলের মতো নামি ব্র্যান্ডের স্কচ তৈরি করা হতো।

দেশের বিভিন্ন স্থানে অনুমোদিত মদের দোকান রয়েছে ২০৩টি। এর ৯০ শতাংশ খোদ রাজধানী ঢাকাতেই। কিন্তু এর বাইরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবৈধ মদের দোকান আছে কয়েক গুণ। প্রভাব আর ক্ষমতার দাপটে এসব অবৈধ দোকান পরিচালনা করা হয়। তবে কয়েক বছর ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনলাইনে মদের অর্ডার দিয়ে সংগ্রহ করছেন ক্রেতারা। ফেসবুকেও রয়েছে ‘ঢাকা বার’, ‘ঢাকা থার্টিফার্স্ট নাইট’ নামের বিভিন্ন পেজ। এসব পেজে অর্ডার দিলে এক ঘণ্টার মধ্যে তা ডেলিভারি দেওয়া হয়। যদিও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সব সময়ই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে মদ কেনার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করছেন। র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন বলেন, ‘গত বছরের শেষ দিকে বিষাক্ত মদ খেয়ে মৃত্যুর একটি সংবাদ শুনেছিলাম। তবে মদে ভেজাল কিংবা বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের কপির বিষয়ে আমরা কিছু অভিযোগ পাচ্ছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, লাইসেন্সধারী মদের বারগুলোতে বিদেশি মদ বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছেন শুল্ক ও গোয়েন্দারা। এতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিদেশি বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের বোতলে মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল, স্পিরিটের পাশাপাশি নেশাজাতীয় অন্যান্য পদার্থ মেশানো নকল মদ গোপনে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। বার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওয়্যারহাউস থেকে কূটনৈতিক পাসপোর্টের বিপরীতে প্রতি মাসে ২০০ ডলারের মদ সরবরাহের বিধান রয়েছে। সিন্ডিকেট তৈরি করে এসব ওয়্যারহাউস থেকে মদ নিয়ে বিক্রি করছিল বিভিন্ন বার। এটি বন্ধে গত বছর শুল্ক বিভাগ প্রতিটি ওয়্যারহাউসে অডিট শুরু করে। এরপর থেকে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে বিদেশি মদের সংকট।

 

ঢাকার একটি ওয়্যারহাউসের সুপারভাইজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আগে আমাদের এখান থেকে বিভিন্ন বারে মদ যেত। শুল্ক গোয়েন্দাদের ম্যানেজ করেই সব চলছিল। তবে এবার আর তাদের ম্যানেজ করা যাচ্ছে না বলেই ঝামেলা হচ্ছে।’ মদের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন বারে আগে সাধারণ মানের ১ লিটার বিদেশি মদ সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় এবং ডিলাক্স ব্র্যান্ডের স্কচ-হুইস্কি ৬ থেকে সাড়ে ৬ হাজার টাকায় দেদার বিক্রি হলেও এখন তা ১১ থেকে ১২ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে। ওয়্যারহাউস ও ডিউটি ফ্রি শপে শুধু ফরেন পাসপোর্টধারী ব্যক্তির কাছে মদ বিক্রির কথা থাকলেও কিছু ‘উপড়ি’ দিলেই যে-কেউ সেখান থেকে অনায়াসেই মদ কিনতে পারছেন। বোতলপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা বেশি দিলেই এলাকার ক্লাবে কিংবা ঘরে বসেই সোর্সের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করছেন অনেকেই। যদিও শুল্ক বিভাগের অভিযানের কারণে কিছুদিন তাতে ভাটা পড়ে। আমরা একটা ব্ল্যাক লেভেল এখান থেকে দিই ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। সেটি বারে বিক্রি হয় ৮ থেকে ৯ হাজার টাকায়। একটা ভ্যাট সিক্সটিনাইন আমরা দিই দেড় হাজার টাকায়, সেটি বাইরে বিক্রি হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকায়। ক্রেতারা ঠিকই বেশি দাম দিয়ে কিনে খান। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত লাভের টাকা যায় সিন্ডিকেটের কাছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসির এক পরিদর্শক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার পরিচিত একজন সম্প্রতি আমাকে জানিয়েছেন, বেশির ভাগ ব্র্যান্ডের মদের স্বাদ তিনি একই রকম পাচ্ছেন। পরে আমরাও খোঁজ নিয়ে দেখেছি, বাজারে প্রচুর কপি মদ ঢুকেছে। আর এগুলোর বেশির ভাগই চাইনিজ। এগুলো দুবাই হয়ে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে সমুদ্রপথে দেশে ঢুকছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজধানীর একটি বারের ম্যানেজার বলেন, ‘ভাই, আমরা চাকরি করি। সব কথা বলা যাবে না। তবে ইদানীং প্রচুর চায়না মদ ঢুকছে এটা সত্য।’

নিয়মিত মদ পান করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর বিষাক্ত মদ পানে বিপুলসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় তারা রীতিমতো আতঙ্কিত। ঝুঁকি এড়াতে তারা মদ খাওয়া কমিয়ে আনছেন। আগের মতো তারা আর অনলাইনে মদ অর্ডার দিচ্ছেন না।

ডিএনসির প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, যে ইথাইল মিথাইল বোঝে না সে যদি মদ তৈরি করে তাহলে তো এ অবস্থা হবেই। দেশে এমন লোকের সংখ্যাই বেশি। যারা মদ পান করে তাদের উচিত হবে পরিহার করতে না পারলেও অনুমোদিত বারে বসে পান করা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর