শনিবার, ৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
বন বিভাগ জানে না সঠিক সংখ্যা

সংকটে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী

শেখ আহসানুল করিম, বাগেরহাট

সংকটে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী

দেশের অক্সিজেনের ভান্ডারখ্যাত বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের অনেক বন্যপ্রাণীর অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। ১৯৯৭ সালের পর একমাত্র রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়া অন্যসব বন্যপ্রাণীর কোনো শুমারি হয়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনের হরিণ, বানর, শূকর, উদবিড়ালসহ অন্যসব বন্যপ্রাণীর হালনাগাদ তথ্য নেই বন বিভাগের কাছে। জলবায়ু পরিবর্তনে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও পরিবেশ দূষণ, ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, চোরা শিকারি, কাঠ পাচারকারী ও আগুন দস্যুদের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এই বনের প্রাণপ্রকৃতি। আর নদী-খালে বিষ দিয়ে জেলেরা মাছ ধরায় মাছ, কাঁকড়া, প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতির ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন জলজপ্রাণী হুমকির মুখে পড়েছে। দীর্ঘ বছর ধরে বন্যপ্রাণী বাড়ছে, নাকি কমছে, তাও অজানা বন বিভাগের। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য হালনাগাদ সংখ্যা ও অবস্থা জানা খুবই জরুরি। অথচ বন বিভাগ জানে না, সুন্দরবনে কত বন্যপ্রাণী রয়েছে। দেশের সংরক্ষিত বনের ৫২ ভাগই সুন্দরবন হলেও এই ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে কর্তৃপক্ষ সময়োপযোগী ব্যবস্থা না নেওয়ায় ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক প্রজাতির বন মহিষ, দুই প্রজাতির গন্ডার, দুই প্রজাতির হরিণ, মিঠাপানি প্রজাতির কুমির, চিতাবাঘ ও চার প্রজাতির পাখি। তারপরও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতবিক্ষত হয়েও সন্তানের মতো উপকূলের কোটি কোটি মানুষকে নিরাপদ রাখা সুন্দরবন নিজেই ভালো নেই। অবশ্য, বন বিভাগ বলছে তারা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট প্যাট্রলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুন্দরবন বিভাগ বলছে, এই ম্যানগ্রোভ বনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। রাত দিন ২৪ ঘণ্টায় ছয় বার প্রাকৃতিক রূপ বদলানো সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৫২ ভাগই ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড (বিশ্ব ঐতিহ্য এলাকা)। বঙ্গোপসাগরের পানিতে দিনে দুবার প্লাবিত সুন্দর বনের আয়তনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগই হচ্ছে জলাভূমি। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই জলাভূমি ‘রামসার’ এলাকা হিসেবে স্বীকৃত। বিশ্বের অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনের তুলনায় সুন্দরবন জীববৈচিত্র্য অধিকতর সমৃদ্ধ। সুন্দরীসহ এই বনে রয়েছে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। সুন্দরবনে বাঘ, হরিণ, কুমির, কিং কোবারা, বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিন, ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ২১০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ রয়েছে। সুন্দরবন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেমন ক্ষতবিক্ষত হয়ে সন্তানের মতো উপকূলের কোটি কোটি মানুষকে নিরাপদ রাখে, তেমনি এই জনপদের লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হিসেবেও কাজ করে। সুন্দরবন সুরক্ষায় সরকার ১৯৯৫ সালে এই বন সন্নিহিত এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। এই নির্দেশনা উপেক্ষা করে সেখানে গড়ে ওঠা শিল্পের বর্জ্যে বনের প্রাণপ্রকৃতি হুমকির মুখে পড়েছে। লোকালয়ের কাছে সুন্দরবন এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় চোরা শিকারিদের হাতে মারা পড়ছে বাঘ-হরিণসহ বন্যপ্রাণী। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে ২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বন বিভাগের হিসাবে ৫৫টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মাত্র ১৭টির। অধিক মুনাফার আশায় বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চামড়া, হাড়, দাঁত, নখ পাচার চোরা শিকারিদের নিত্য দিনের ঘটনায় দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া এক শ্রেণির জেলে খালে বিষ ও বনে আগুন দিয়ে মিঠাপানির মাছ আহরণ করে হুমকিতে ফেলেছে সুন্দরবনের মৎস্য ভান্ডারকেও। পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনে। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ না থাকায় জলবায়ু পরিবর্তনে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ছে। এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোয়ারে সুন্দরবনের সবচেয়ে উঁচু এলাকা করমরজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রও ২ থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। পানিতে নষ্ট হচ্ছে বন্যপ্রাণীর ডিম। এতে কুমিরসহ যেসব বন্যপ্রাণী ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বংশ বিস্তার করে তা ব্যাহত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের পর থেকে বাঘ ছাড়া হরিণসহ অন্যসব বন্যপ্রাণীর কোনো জরিপ হয়নি। এতে খোদ বন বিভাগও জানে না, কোন প্রজাতির কতটি প্রাণী সুন্দরবনে রয়েছে। ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বাঘের সংখ্যা ১১৪ টিতে দাঁড়ায়। সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও সুন্দরবন গবেষক ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বন্যপ্রাণীর খাদ্য শৃঙ্খলের অবস্থা ও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার জন্য সুন্দরবনে কোন বন্যপ্রাণী কতটি রয়েছে তা জানা খুবই জরুরি। বন সংরক্ষণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে বণ্যপ্রাণীদের ওপর জরিপ পরিচালনা করা উচিত। বন্যপ্রাণীর সঠিক তথ্য না থাকায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াসহ সুন্দরবনের ওপর পর্যটকদের চাপ কমানো ও ইসিএভুক্ত এলাকায় নতুন করে শিল্পকলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এই ম্যানগ্রোভ বনে লোকবলসহ নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধি, বনের ওপর নির্ভরশীলদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, কঠোরভাবে চোরা শিকারি, কাঠ পাচারকারী ও বনে আগুন দিয়ে সম্পদ লুটেরাদের দমন করতে না পারলে সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষা করা যাবে না। বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনে বনভূমি ৪ হাজার ৮৩২ বর্গকিলোমিটার ও জলাভূমি ১ হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ২০১৫ সালের বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। ২০১৮ সালের শুমারিতে ১১৪টি পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালের সর্বশেষ সমীক্ষায় কুমিরের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ১৫০-২০৫টি। ওই সমীক্ষায় কুমিরের জন্য সাতটি হুমকি চিহ্নিত করা হয়। সুন্দরবনের হরিণ, বানর, কর, উদবিড়ালের সবশেষ শুমারি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই শুমারির তথ্য অনুযায়ী, বনে হরিণ ছিল ১ থেকে দেড় লাখ, বানর ৪০ থেকে ৫০ হাজার, শূকর ২০ থেকে ২৫ হাজার ও উদবিড়াল ২০ থেকে ২৫ হাজার। এরপর আর এই চারটি বন্যপ্রাণীর কোনো শুমারি হয়নি। ফলে বর্তমান সংখ্যা কিংবা অবস্থা বন বিভাগের জানা নেই। এ ছাড়া সুন্দরবনের গুইসাপ, অজগর, কচ্ছপ, পাখি, বনমোরগসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর কখনো শুমারি হয়নি। ম্যানগ্রোভ এই বনের এত সংকটের মধ্যেও আশার কথা জানিয়ে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) বলেছেন,  আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট প্যাট্রলিংসহ সুন্দরবনের প্রাণপ্রকৃতি রক্ষার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি ১৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হলে দ্রতই সুন্দরবনের সব বন্যপ্রাণীর জরিপ শুরু হবে। আগামী জুন মাসের মধ্যে ৮৪টি পুকুর খননও পুনঃখননের মাধ্যমে বন্যপ্রাণীর সুপেয় পানির চাহিদা মেটাবে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হবে। এতে সুন্দরবন অনেক সুরক্ষিত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর