সোমবার, ৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

খাদ্য নিরাপত্তার প্রশিক্ষণে নেই খাদ্য কর্মকর্তা

সচিবের নেতৃত্বে বিদেশ সফরে ১১ সদস্যের দল

উবায়দুল্লাহ বাদল

দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, ঝুঁকি ও সংকট ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ১০ দিনের সফরে যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক যাচ্ছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১১ কর্মকর্তা। খাদ্য সচিবের নেতৃত্বে এই প্রতিনিধি দলে আছেন মন্ত্রণালয়ের তিনজন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্মসচিব ও ছয়জন উপসচিব। তারা সবাই প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তবে এই প্রশিক্ষণ সফরে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করা খাদ্য ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তাকে রাখা হয়নি। এমনকি যারা নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করেন, সেই নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কাউকেও রাখা হয়নি।

প্রতিনিধি দলটি কাল (মঙ্গলবার) প্রশিক্ষণের উদ্দেশে দেশত্যাগ করার কথা রয়েছে। এদের মধ্যে খাদ্য সচিব ও একজন অতিরিক্ত সচিবের চাকরির মেয়াদ রয়েছে মাত্র তিন মাস। অপর এক অতিরিক্ত সচিবও অবসরে যাবেন নয় মাস পর। ফলে প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান খাদ্য নিরাপত্তা বা সংশ্লিষ্ট খাতে কতটুকু অবদান রাখবে এবং দেশ-জাতির কতটুকু উপকারে আসবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক কেন বেছে নেওয়া হলো তা সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে যেহেতু প্রশিক্ষণ, সেখানে অবশ্যই খাদ্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পাঠানো উচিত। যেহেতু খাদ্যের বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট ক্যাডার রয়েছে সুতরাং তাদের মধ্য থেকেই  বেশিরভাগ কর্মকর্তা পাঠালে ভালো হতো। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ শেষ পর্যায়ে তারা প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কোথায় প্রয়োগ করবেন। যারা প্রশিক্ষণে যাচ্ছেন তারা যে কোনো সময় অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যেতে পারেন। এতে প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্যই ভেস্তে যাওয়ার পাশাপাশি এই খাতের সব টাকাই জলে পড়বে। এ বিষয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত।’

প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা অফিস আদেশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত ও এর ঝুঁকিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে যুক্তরাজ্য ও তুরস্কে শিক্ষা সফরে যাচ্ছেন খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মাৎ নাজমানারা খানুম। তিনি বর্তমানে এক বছরের চুক্তিতে চাকরি করছেন। বিসিএস ১৯৮৬ ব্যাচের এই কর্মকর্তা চাকরি থেকে নিয়মিত অবসরে যান গত বছরের জুনে। এরপর তিনি এক বছরের জন্য চুক্তিতে নিয়োগ পান। আগামী জুনের প্রথম দিকেই তার চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। চুক্তির মেয়াদ না বাড়লে তার চাকরির মেয়াদ আছে মাত্র তিন মাস। একই অবস্থা প্রতিনিধি দলের অপর অতিরিক্ত সচিব শাহ নেওয়াজ তালুকদারের। ত্রয়োদশ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তা আগামী ২৯ জুন অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা রয়েছে। প্রতিনিধি দলের অপর সদস্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এফপিএমইউএর মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো. শহীদুজ্জামান ফারুকী আগামী ডিসেম্বরে পিআরএলে যাবেন। একাদশ বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারের এই কর্মকর্তার আর মাত্র চাকরি আছে নয় মাস। ফলে এই তিন কর্মকর্তার চাকরির শেষপ্রান্তে বিদেশ প্রশিক্ষণে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান দেশে ফিরে প্রয়োগ করতে না পারলে সরকারের পুরো টাকাই জলে যাবে। অথচ সরকারপ্রধান একাধিক সচিব সভায় প্রশিক্ষণে সবসময় মধ্যম সারির (যুগ্মসচিব ও উপসচিব) এবং বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের সভায় যাদের চাকরির মেয়াদ ছয় মাসের কম, তাদের প্রশিক্ষণে নিরুৎসাহিত করার জন্য বলা হয়। এ ছাড়া প্রশিক্ষণে যাচ্ছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ত্রয়োদশ বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা খুরশিদ ইকবাল রিজভী, ২০তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা যুগ্মসচিব (প্রশাসন)এ কে এম মামুনুর রশিদ, ২৫তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা ও খাদ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) শহীদুজ্জামান, ২৭তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা খাদ্য সচিবের পিএস মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ, মর্জিনা আক্তার ও হুরে জান্নাত। এ ছাড়া ১৯তম বিসিএসের প্রাণিসম্পদ ক্যাডারের কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. সৌরেন্দ্র নাথ সাহা এবং ২০তম বিসিএসের কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তা ও মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. কামরুজ্জামান রয়েছেন প্রতিনিধি দলে। এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নিজ খরচে যাচ্ছেন  যুগ্মসচিব (প্রশাসন) এ  কে এম মামুনুর রশিদের স্ত্রী ও কন্যা। অথচ খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে কাজ করা খাদ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কাউকে প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিনিধি দলে রাখা হয়নি।

খাদ্য অধিদফতর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশিক্ষণে মধ্যম সারির এবং বিষয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিতে বলা হলেও এখানে তা মানা হয় না। যে অনুষ্ঠান বা প্রশিক্ষণে সিনিয়র সহকারী সচিব/ উপসচিব যাওয়ার কথা সেখানে সচিব বা অতিরিক্ত সচিবরা যাচ্ছেন। যেখানে অধিদফতর বা সংস্থার কর্মকর্তারা গেলেও চলে বা আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছে, সেখানেই মন্ত্রণালয়ের বড় কর্মকর্তারা নিজেদের নাম জুড়ে দিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রশিক্ষণে স্ত্রী-কন্যা গেলে সেখানে আর প্রশিক্ষণ থাকে না। সেটা ভ্রমণে রূপ নেয়। কারণ বড় কর্তার স্ত্রী-সন্তানদের জন্য ছোট কর্তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। ফলে প্রশিক্ষণের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়।

এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমের দফতরে গেলে জানানো হয় খাদ্যসচিব কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি অনুষ্ঠানে আছেন। এরপর সন্ধ্যায় একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। প্রতিবেদকের পরিচয় দিয়ে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সর্বশেষ খবর