মঙ্গলবার, ৮ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

আমলার নিয়ন্ত্রণ পোক্ত উপজেলায়

♦ ফাইন্যান্স অফিসার পদ সৃষ্টি করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগের প্রস্তাব ♦ মামলাসহ অন্যান্য জটিলতা নিরসনের সুপারিশ প্রণয়নে পাঁচ সদস্যের কমিটি

উবায়দুল্লাহ বাদল

বিদ্যমান আইন সংশোধন করে পরিষদে হস্তান্তরিত ১৭ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও এ-সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ বাবদ সরকারের দেওয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমা দিতে বলেছিল সরকার। উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে ২০১১ সালে এ সংশোধনীর এক যুুগ পার হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি আজও। উপজেলা চেয়ারম্যানদের দাবি, আইন সংশোধন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) পরিষদের ‘সচিব’ হতে ‘মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা’ হয়ে পরিপত্র জারির মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে হস্তান্তরিত দফতরগুলোর প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও জনপ্রতিনিধিরা কাক্সিক্ষত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারছেন না। ক্ষমতা ফিরে পেতে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যানরা। এমন পরিস্থিতিতে আমলাদের ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করতে উপজেলা পরিষদে ‘ফাইন্যান্স অফিসার’ নামে নতুন পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ওই পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হতে পারেননি ‘উপজেলা পরিষদ হস্তান্তরিত বিষয়ে কার্যক্রম পর্যালোচনা, পরামর্শ প্রদান এবং নির্দেশনা জারি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র সদস্যরা। কমিটির বড় একটি অংশ মনে করে, আইন অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলা পরিষদে একজন সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে, যা প্রক্রিয়াধীন। হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগের পর ‘ফাইন্যান্স অফিসার’ নিয়োগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। নতুন করে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে ঝামেলা আরও বাড়বে। তবে অন্য অংশটি প্রস্তাবের পক্ষে অনড় থাকায় বিষয়টি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দিয়েছে কমিটি।

এ ছাড়া উপজেলা চেয়ারম্যানদের সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে হাই কোর্টে দায়ের করা রিট ও তাদের দাবিসমূহ এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে হস্তান্তরিত দফতর/কর্ম-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে সুপারিশ তৈরি করতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জিল্লুর রহমান চৌধুরীকে। দুই মাসের মধ্যে সুপারিশ জমা দিতে বলা হয়েছে কমিটিকে। ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত ‘উপজেলা পরিষদ হস্তান্তরিত বিষয়ে কার্যক্রম পর্যালোচনা, পরামর্শ প্রদান এবং নির্দেশনা জারি সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র ১৮তম সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির সভাপতি ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট ১৭ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাঠ প্রশাসন) জিল্লুর রহমান চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখনো বৈঠকে বসিনি। উপজেলা-সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও বিধিমালাসহ এ-সংক্রান্ত সব আদেশ ও পরিপত্রের আলোকে একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করতে বলেছি। তাতে উপজেলা চেয়ারম্যানদের দাবি ও তাদের মামলার আরজিসহ সব ধরনের তথ্য থাকবে। ওইসব তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সেবা পাওয়ার পরিবেশ তৈরি করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বৈঠকে ফাইন্যান্স অফিসার পদে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ প্রসঙ্গে বলা হয়, উপজেলা পরিষদে ফাইন্যান্স অফিসার বিভিন্ন বিষয়/নথি পর্যালোচনা বা যাচাই করে ইউএনওর মাধ্যমে পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে নিষ্পত্তির জন্য উপস্থাপন করলে পরিষদের কাজকর্মে অধিকতর স্বচ্ছতা ও বিধিবিধান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা সহজ হবে। বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সহকারী কমিশনারদের ওই পদে নিয়োগ কিংবা সহকারী কমিশনারদের (ভূমি) অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা হয়। প্রতিটি উপজেলায় সহকারী কমিশনার (ফাইন্যান্স/ফাইন্যান্স অফিসার) পদে অনুরূপ নিয়োগ/দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে জনবলস্বল্পতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে যেসব উপজেলা পরিষদের কর্মপরিধি বেশি সেগুলোয় পদায়ন করা যায় কি না তা নিয়ে আলোচনা হয়। ২০১১ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ আইনে ৩৪(৩) ধারায় একজন সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান সন্নিবেশ করা হয়েছে। খসড়া বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োগ হলে ‘ফাইন্যান্স অফিসার’ নিয়োগের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা-ও পরীক্ষার প্রয়োজন। এ বিষয়ে পরীক্ষান্তে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। হস্তান্তরিত ১৭টি বিভাগের প্রসঙ্গে বলা হয়, রিটে উপজেলা চেয়ারম্যানরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০১৫ সালের জারি করা পরিপত্রের বাস্তবায়ন চেয়েছেন। ওই পরিপত্রের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত ১৭টি বিভাগের জনবল এবং তাদের বেতন-ভাতা ও এ-সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ বাবদ সরকারের দেওয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রদত্ত সিদ্ধান্তের অনুবৃত্তিক্রমে ওই নির্দেশনা জারি করা হয়। কিন্তু পরে নানাবিধ আপত্তি/প্রতিবাদ ও পরিস্থিতিতে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিষয়টি অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি সংরক্ষিত কার্যাবলি ও উপজেলা পরিষদে হস্তান্তরিত কাজের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টীকরণ এবং সরকার ও পরিষদের এখতিয়ারের বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে নির্দেশনা জারির পরামর্শ দেওয়া হয় বৈঠকে।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী হস্তান্তরিত ১৭টি বিভাগের জনবল ও তাদের বেতন-ভাতা এবং এ-সংক্রান্ত ব্যয় নির্বাহ বাবদ সরকারের দেওয়া অর্থ উপজেলা পরিষদে জমাদানের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে অবশ্যই ফাইন্যান্স অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু সরকারের ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করে নতুন করে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে জটিলতা আরও বাড়াবে। ফান্ড নেই ফাইন্যান্স অফিসার দিয়ে কী করবে পরিষদ। আগে আইনের বাস্তবায়ন হোক, তারপর কর্মকর্তা নিয়োগ দিন। উপজেলা পরিষদের সভাগুলো চেয়ারম্যানরা নন, ইউএনওরা তাদের মতো করে চালান। ইউএনওদের নেতৃত্বে অনেক কমিটি কাজ করলেও পরিষদের স্থায়ী কমিটিগুলো অ্যাকটিভ নয়। উপজেলা পরিষদ চলছে একটা হযবরল অবস্থার মধ্য দিয়ে।’ উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিযোগ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পাশ কাটিয়ে ইউএনওদের হস্তান্তরিত ১৭টি দফতরের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা দেওয়ায় প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ ইউনিট। আইন অনুযায়ী সব উপজেলাকে প্রশাসনিক অংশ ঘোষণার পর উপজেলা পর্যায়ের ১৭ বিভাগকে উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। হস্তান্তর করা এসব কাজ সম্পাদনে উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুমোদন নেওয়ার কথা; কিন্তু চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের পাশ কাটিয়ে সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ইউএনওরা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুন অর রশীদ হাওলাদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাংবিধানিক নির্দেশনা প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা। এজন্য?ই বঙ্গবন্ধু জেলায় জেলায় গভর্নর পদ্ধতি চালু করেন। এরশাদ সরকার এক?ই নির্দেশনায় জেলা পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইনকে আরও সমৃদ্ধ করে উপজেলা পরিষদ প্রবর্তন করেন। এটাই গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ। উপজেলা পরিষদ আইনের তৃতীয় তফসিলে (সংশোধিত) পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে, ১৭ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কার্যাবলি উপজেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হ?লো। এটা প্রতিপালনের জন্য আইনের ৩৫ ধারায় বলা হয়েছে, হস্তান্তরিত বিভাগসমূহের বার্ষিক উন্নয়ন ও রাজস্ব ব্যয় উপজেলা পরিষদ তহবিলের মাধ্যমে জমা ও ব্যয় হ?বে। এজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে নির্দেশনা বিদ্যমান। ঔপনিবেশিক মনোভাবের কারণে আজ পর্যন্ত তা প্রতিপালন করা হচ্ছে না। হাই কোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও আজও নির্বাচিত পরিষদ অকার্যকর, জনপ্রতিনিধি মর্যাদাহীন। ১৭ বিভাগের কার্যাবলি পরিষদের কাছে না দিয়ে ফাইন্যান্স অফিসার নিয়োগ প্রশাসনের কর্মচারীদের পুনর্বাসনের পদ সৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই নয়।’

সর্বশেষ খবর