মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

যুদ্ধ আরও তীব্র, বাড়ছে লাশ

কিয়েভে রুশ বাহিনীর তুমুল গোলা বর্ষণ, চলছে শান্তি আলোচনাও

প্রতিদিন ডেস্ক

যুদ্ধ আরও তীব্র, বাড়ছে লাশ

কিয়েভে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন -এএফপি

ইউক্রেন অভিযানের ১৯তম দিনে গতকাল রাজধানী কিয়েভের ওপর চারদিক থেকে রুশ বাহিনী গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। গোলার আঘাতে একটি বহুতল ভবন বিধ্বস্ত হয়ে দুজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে যুদ্ধের ভিতরও এদিন রুশ ও ইউক্রেনের মধ্যে ভিডিও কনফারেন্স শুরু হয়। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আলোচনার ফলাফল জানা যায়নি।

সিএনএনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রাজধানী কিয়েভে ভারী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় সময় সোমবার বেলা ১১টায় শক্তিশালী বিস্ফোরণগুলো ঘটে। খবরে বলা হয়, ক্রুজ মিসাইল অথবা ইউক্রেনের বিমান বাহিনীর রুশ বিমান টার্গেটের কারণে এ বিস্ফোরণ হয়েছে। ফলে মধ্য কিয়েভের আকাশে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এর আগে ভোরবেলা কিয়েভের উপকণ্ঠের আবাসিক ভবনে হামলায় অন্তত দুই ব্যক্তি নিহত হন। ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় জরুরি সেবা বিভাগ বলেছে, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে ভবনটিতে হামলা হয়। এ ঘটনার পর দুজনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আহত চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। জরুরি সেবা বিভাগ প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, নয় তলাবিশিষ্ট ওই আবাসিক ভবন থেকে ধোঁয়া বের হয়ে আসছে। ভবনের বাসিন্দাদের উদ্ধারে মই ব্যবহার করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

বিবিসি জানিয়েছে, রাজধানী কিয়েভের আবাসিক ভবনগুলো লক্ষ্য করে রুশ বাহিনী তুমুল গোলাবর্ষণ করে চলেছে। ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় জরুরি সেবা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, রাজধানী কিয়েভের কুরেনিভকা এলাকায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত আবাসিক ভবনের ধ্বংসাবশেষ রাস্তায় পড়ে একটি বাস ধ্বংস হয় এবং আরেকটি আবাসিক ভবনে আগুন ধরে যায়। বাসে কোনো যাত্রী ছিল না। তবে বাসটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয় এলাকার এক বাসিন্দা পরিস্থিতির বর্ণনায় বলেছেন, হামলার সময় তিনি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন এবং দেখতে পান সিঁড়িঘরটি আর নেই। সবখানে আগুন জ্বলছে। আরেক খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের আন্তনোভ বিমানবন্দরে রুশ গোলাবর্ষণ ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গোলাবর্ষণের পর বিমানবন্দরটির ওপরে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উড়ছে। উল্লেখ্য, কিয়েভের উত্তরাঞ্চলীয় এ আন্তনোভ বিমানবন্দর হোস্তমেল নামেও পরিচিত। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক কার্গো বিমানবন্দর ও অন্যতম প্রধান সামরিক ঘাঁটি।

এদিকে পরিস্থিতির মধ্যেও কিছু আশা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে চলছে ইউক্রেনের শান্তি আলোচনা। ইউক্রেন জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি, অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহার এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নিয়ে তারা রাশিয়ার সঙ্গে চতুর্থ দফা ‘কঠিন’ আলোচনা শুরু করেছে। ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক মুখপাত্র অগ্রগতির আভাস দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে। এর আগে দুই পক্ষে দফায় দফায় আরও আলোচনা হয়েছিল। তাতে কেবল ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর-নগরে মানবিক ত্রাণ কাজ চালানো এবং বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতি করা নিয়ে সমঝোতা হয়েছিল। যদিও সেসব যুদ্ধবিরতি বারবারই লঙ্ঘিত হয়েছে।

১৮০ ভাড়াটে সেনাকে হত্যার দাবি রাশিয়ার : ন্যাটোর সদস্য দেশ পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে অবস্থিত ইউক্রেনের বৃহৎ সামরিক প্রশিক্ষণ ঘাঁটিতে গত রবিবার বোমাবর্ষণের পর রাশিয়া বলেছে, ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ওই সেনা প্রশিক্ষণ শিবিরে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ১৮০ জন বিদেশি ভাড়াটিয়া সেনা নিহত হয়েছেন। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, হামলায় পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী ইয়াভোরিভ শহরের ওই প্রশিক্ষণ শিবিরে থাকা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ ধ্বংস হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাশেঙ্কভ বলেন, দূরপাল্লার অতি-নিখুঁত ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার এবং নিকটস্থ স্টারিচি গ্রামের আরেকটি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিদেশি ভাড়াটিয়া সেনাদের পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী ওই শিবিরে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর ফ্রন্টলাইনগুলোয় রাশিয়ার সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পাঠাচ্ছিল ইউক্রেন। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ইউক্রেনে বিদেশি ভাড়াটিয়াদের বিরুদ্ধে হামলা অব্যাহত থাকবে। প্রসঙ্গত, রাশিয়া বারবার ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র ও ভাড়াটিয়া সেনা দিয়ে সাহায্য করার ব্যাপারে পশ্চিমা দেশগুলোকে সতর্ক করে দিচ্ছে। মস্কো বলেছে, পাশ্চাত্য এ কাজ বন্ধ না করলে ‘বিশ্বজুড়ে বিপর্যয়’ দেখা দেবে।

আঘাতের পরও যুদ্ধবিমান নামালেন রুশ পাইলট : রাশিয়ার একজন পাইলট তার এসইউ-২৫ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা নিরাপদে নামাতে সক্ষম হয়েছেন। অসম সাহসিকতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য রুশ সরকার এরই মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডেনিস লিটভিনভ ও বিমানের কো-পাইলটকে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিয়েছে। রাশিয়ার স্পুৎনিক বার্তা সংস্থা এবং ডিফেন্স ওয়ার্ল্ড ডট নেট জানিয়েছে, এসইউ-২৫ বিমান নিয়ে দুই পাইলট ইউক্রেনে অভিযান চালাতে চান। এ অভিযানে দুটি বিমান ছিল। এ সময় ইউক্রেনের সেনাদের ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসইউ-২৫ বিমানে আঘাত করে। প্রকৃতপক্ষে সহযোগী বিমানটিকে রক্ষা করতে গিয়েই পাইলট লিটভিনভ নিজের জীবন ও বিমানের ঝুঁকি নেন।

ইউক্রেনকে বাঁচাতে হলে ছয় দফা প্রস্তাব : ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান বন্ধ করার জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছে রাশিয়ার পার্লামেন্ট দুমা। দুমার ডেপুটি স্পিকার মিখাইল শিরিমিত রবিবার ক্রিমিয়া উপত্যকা সফরে গিয়ে বলেন, জেলেনস্কি যদি সত্যিই এখনো ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন তাহলে তাকে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেনে নিতে হবে। যেমন নব্য নাৎসিবাদীদের নিরস্ত্র করতে হবে, ইউক্রেনকে অস্ত্রসমর্পণ করতে হবে, দেশটির সংবিধানে নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে কোনো আন্তর্জাতিক ব্লকে যোগ দেওয়া না যায়, ইউক্রেনের বেশির ভাগ মানুষের মাতৃভাষা অর্থাৎ রুশ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ক্রিমিয়া উপত্যকাকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে এবং লুহানস্ক ও দোনেস্ক অঞ্চলের স্বাধীনতা মেনে নিতে হবে।

রুশ মিসাইল হামলা ন্যাটোর জন্য একটি বার্তা : রবিবার পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে মিসাইল হামলা চালানোকে বিশ্বের সবচেয় বড় সামরিক জোট ন্যাটোর জন্য একটি বার্তা ও হুমকি বলে মনে করছে পোল্যান্ড। পোল্যান্ডের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্সিন প্রজাইডাকজ বিবিসিকে এ কথা বলেন। তিনি রাশিয়ার হামলাকে ‘উচ্চ উসকানিমূলক প্রচেষ্টা’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘তারা অবশ্যই জানে এ সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি পোল্যান্ড সীমান্তের খুব কাছাকাছি এলাকায়। তার পরও তারা সেখানে হামলা চালিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা ন্যাটোকে হুমকি দিচ্ছে। এ হামলা সে বার্তাই বহন করে।’

পুতিনের সাক্ষাৎ চান জেলেনস্কি : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। জেলেনস্কি গতকাল এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে এখন আলোচনা করা দরকার। আমাদের দেশের আলোচকরা প্রতিদিন ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আলোচনা করছেন। আমাদের প্রতিনিধি দলের সবকিছু করার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে দুই প্রেসিডেন্টের মধ্যে বৈঠকের আয়োজন করা। আমি নিশ্চিত যে লোকজন এমন একটি বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছে।’ জেলেনস্কি আরও বলেন, ‘এ ধরনের বৈঠকের আয়াজন করা কঠিন কাজ, তবে জরুরি।’ ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট তাঁর ভিডিওবার্তায় ন্যাটো জোটকে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে বলেন, ‘এ জোটের সদস্য দেশগুলো শিগগিরই রাশিয়ার বাহিনীর দ্বারা হামলার শিকার হবে।’ পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে ইউক্রেনের একটি সামরিক ঘাঁটিতে রুশ বাহিনী বিমান হামলা চালানোর পর জেলেনস্কি ন্যাটো দেশগুলোকে এ সতর্কবার্তা দেন।

সর্বশেষ খবর