মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

এগিয়ে যেতে চাই আগামীকে জয় করে

নঈম নিজাম

এগিয়ে যেতে চাই আগামীকে জয় করে

দেখতে দেখতে শেষ হলো ১২টি বছর। এক যুগ শেষ করে দ্বিতীয় যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ প্রতিদিন। এক বিশাল চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়েই পার করতে হয়েছে ১২ বছর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের ছিল করোনা   মহামারি মোকাবিলা করে প্রচার সংখ্যার শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখা। বাংলাদেশ প্রতিদিন তা ধরে রেখে সংবাদপত্রে তৈরি করেছে এক নতুন ইতিহাস, নতুন অধ্যায়। এ অধ্যায় কঠিনতম সময়ে স্বপ্ন জয় করে সৃষ্টিশীলতার সাফল্য এগিয়ে নেওয়ার। আগামী দিনের মিডিয়াকে পথ দেখানোর। সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখার।

অসম্ভবকে সম্ভব করার কারণটা শুধু পাঠকের ভালোবাসা। করোনাকাল সারা দুনিয়াকে বদলে দিয়েছে। বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই সময়ে। অনেকে শুধু অনলাইনে টিকে থাকার চেষ্টা করেছিল তখন। বাংলাদেশেও এ সেই কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা সহজতর ছিল না। ভয়, শঙ্কা আর গুজব জয় করেই প্রিন্ট মিডিয়া টিকিয়ে রেখেছি আমরা। অনেক সংবাদকর্মী সামাজিক মাধ্যমে তখন লিখেছিলেন, পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যাঁরা লিখলেন তাঁরা ভাবলেন না একবার বন্ধ হলে পত্রিকা অফিস আবার চালু করা যায় না। সারা দেশে তখন ছিল সাধারণ ছুটি। অনেক এলাকায় পত্রিকা হকারের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় পাহারা বসিয়ে মানুষের প্রবেশে ছিল নিষেধাজ্ঞা। আর কোনো বাড়িতে করোনা আক্রান্ত থাকলে তো কথাই নেই। টানিয়ে দেওয়া হতো লাল পতাকা। সে বাড়িটি হয়ে যেত সবার জন্য নিষিদ্ধ। মানুষ হারিয়েছিল সহনশীলতা। মানবিকতাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। করোনা আক্রান্তের ওপর হামলার মতো বর্বরোচিত ঘটনাও ঘটেছিল। অনেক সন্তান আক্রান্ত সন্দেহে বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। একজন মাকে তার সন্তানরা জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল। সে পরিস্থিতিতে আমরা চিন্তিত ছিলাম পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখা নিয়ে। সংবাদপত্রের প্রকাশনা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। এ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম শুধু পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতাদের ভালোবাসার কারণেই।

সংবাদপত্রের পথচলা কখনো মসৃণ ছিল না। সব সময় কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পথ চলতে হয়েছে সংবাদপত্রকে। আমাদের এ অঞ্চলে ১৭৮০ সালে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেন জেমস অগাস্টাস হিকি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটির নাম ছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’। নাম বেঙ্গল গেজেট হলেও পত্রিকার ভাষা ছিল ইংরেজি। ইংরেজ মানুষটি পত্রিকা বের করার পর এ উপমহাদেশে আসা স্বজনরা খুশি হয়েছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন হিকি ইংরেজের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন মিডিয়ায়। কিন্তু হিকি তা করেননি। তিনি মানুষের কথা বলেছেন সংবাদপত্রে। ইংরেজের অপকর্ম তুলে ধরেছেন। প্রশাসনের অনিয়মের খবর ছিল তাঁর পত্রিকায়। ইংরেজের লুটপাটের কাহিনিও বাদ যায়নি। এমনকি ইংরেজ সেনাদের ব্যর্থতা ও লোভের খবরও প্রকাশিত হতো। ব্যস, আর যায় কোথায়? সবকিছু তুলে ধরার কঠিন খেসারত হিকিকে দিতে হয়েছিল। পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। কারাবরণ করতে হয় তাঁকে। প্রেস জব্দও হয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে আফ্রিকায় দাস পাঠানোর প্রতিবাদ জানিয়েও কলম ধরেছিলেন হিকি। তিনি লিখেছেন, ‘যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়- একজন সাহসী মানুষ আর একটি স্বাধীন সংবাদপত্র তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না।’ ভাবতেও পারছি না সে যুগে এভাবে স্পষ্ট করে কথা বলা আর বলতে পারার বীরত্বটা। সে কারণে কঠিন খেসারতও দিতে হয়েছিল হিকিকে। একদিকে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার। অন্যদিকে বরণ করতে হয়েছিল কারাবাস। সংবাদপত্র কি হিকির চ্যালেঞ্জ থেকে বের হতে পেরেছে? মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একটি কথা। তিনি বলেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। কাঠিন্যকে ভালোবেসে এ পেশায় থাকতে হয়। একজন পরিপূর্ণ সংবাদকর্মীই পারেন অনেক কিছুতে পরিবর্তন আনতে। আর সে কারণে কাউকে কাউকে কঠিন খেসারতও দিতে হয়। কেউ বুঝতে চান না স্বাধীন মিডিয়া ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। একটি দেশ উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। মানবাধিকার সংরক্ষিত হতে পারে না। অথচ সারা দুনিয়ার মিডিয়াকে কঠিন সময় পার করতে হয়। আমাদের দেশে অনেকে বলেন, মিডিয়া তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে না। কেউ বুঝতে চান না সব প্রতিষ্ঠান যখন শেষ হয়ে যায় তখন কীভাবে একলা দায়িত্ব পালন করবে মিডিয়া! মিডিয়া তো সমাজের বাইরের কিছু না। সামাজিক, নৈতিক মূল্যবোধ শেষ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পদে পদে চ্যালেঞ্জে নিয়ে চলছে। নানামুখী মানসিক চাপ নিয়েই মিডিয়া কাজ করছে। কাউকে খুশি করা যায় না। এক কঠিন সংকট মোকাবিলা করছেন মিডিয়া কর্মীরা। সমালোচনা কেউ সহ্য করে না, এ অবস্থায় সংকুচিত হচ্ছে বিজ্ঞাপনের বাজার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ইলেকট্রনিক মিডিয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য। কমছে প্রিন্ট মিডিয়ার প্রচার সংখ্যা। আছে অনেক কালাকানুন। কথায় কথায় প্রভাবশালীদের হুমকি। যখন তখন মামলা, হামলা। সারা দুনিয়ায় একই চিত্র। আমেরিকার মতো উন্নত গণতন্ত্রের দেশও এর বাইরে নয়। অনেকে হয়তো বলবেন হুমকি, সংকট অতীতেও ছিল। আমিও তা মনে করি। কাঙ্গাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’র খবরও সে যুগে জমিদারদের ভালো লাগেনি। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকার সম্পাদক সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ ছিলেন কাঙ্গাল হরিনাথ। কুষ্টিয়ার একটি গ্রাম থেকেই পত্রিকা প্রকাশ করে তিনি চাঞ্চল্য তৈরি করেন। জমিদারের অত্যাচার আর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ছিল তীক্ষè। তিনি কোনো কিছুর তোয়াক্কা করতেন না। একবার জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনী হামলা করলে লালন শাহের নেতৃত্বে গ্রামবাসী তাঁকে রক্ষা করেন। আবার তিনিও একাধিকবার লালন শাহকে রক্ষা করেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের দ্বিতীয় যুগে প্রবেশের এমন দিনে স্পষ্ট করে বলতে চাই- পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতা টিকবে না। টিকতে পারে না। দুনিয়ার কোথাও টেকেনি। গণতন্ত্রের বিকাশে মিডিয়ার ভূমিকা হতে হবে সাহসী। সত্য অবশ্যই উচ্চারণ করতে হবে। আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মিডিয়ার ভূমিকা থাকতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রথম দিন থেকে তার দায়িত্বের জায়গায় ছিল অবিচল। আমরা চেষ্টা করছি খবরের আড়ালের সঠিক তথ্য পাঠককে জানাতে। আমাদের অঙ্গীকার মানুষের প্রতি। হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন আমাদের শক্তি। পাঠকের ভালোবাসায় বাংলাদেশ প্রতিদিন আজ দেশের প্রচার সংখ্যার শীর্ষে। মাননীয় তথ্যমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রদত্ত সর্বশেষ তথ্যেও বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সর্বাধিক প্রচার সংখ্যার কথা। আমরা চেষ্টা করছি পাঠকের চাহিদা ধরে রাখতে। জানি, একটি পত্রিকার ধারাবাহিক সাফল্য ধরে রাখা ও টিকে থাকা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের। সে চ্যালেঞ্জই আমরা জয় করেছি পাঠকের অফুরন্ত ভালোবাসায়। আমরা চেষ্টা করছি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে দুর্নীতি, অনিয়ম তুলে ধরতে। পাশাপাশি দেশের ইতিবাচক খবরগুলোও পাঠককে জানাতে। আমরা দেখেছি পাঠক ইতিবাচক খবর ভালোভাবে নিচ্ছেন। সফলতার খবর সবাই পড়তে চায়। গ্রামের একজন সাধারণ কৃষকের সাফল্যকে এখন সবাই অভিনন্দন জানায়। তরুণদের জয়জয়কার এখন বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশেও তারুণ্য এগিয়ে চলেছে। এ এগিয়ে চলাকে আমরা উৎসাহিত করি। মিডিয়াকে সময়ের সঙ্গে থাকতে হয়। আমরা সময়ের সঙ্গে চলায় বিশ্বাস করি। আধুনিক ডিজিটাল দুনিয়া থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ প্রতিদিন। আমাদের লন্ডন ও নিউইয়র্ক সংস্করণ সাড়া জাগিয়েছে। অনলাইন পড়ছেন বিশ্বের ১৭৬ দেশের পাঠক। দিন দিন বাড়ছে অনলাইনের চাহিদা। আমরা চেষ্টা করছি সর্বশেষ খবর তুলে ধরতে।

দ্বিতীয় যুগে প্রবেশের দিনে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা পাঠক, গ্রাহক, বিজ্ঞাপনদাতা, বিক্রয় প্রতিনিধি, হকারসহ শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি। এঁদের সবার সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ প্রতিদিন আজকের অবস্থানে আসতে পারত না। কৃতজ্ঞতা বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের প্রতি। বসুন্ধরা গ্রুপ চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান আধুনিক চিন্তার একজন মানুষ। তাঁর বলিষ্ঠ বিনিয়োগ, মিডিয়াকে ঘিরে আধুনিক চিন্তাভাবনা, গাইডলাইন আমাদের পথচলার সাহস ও শক্তি। বিশাল সাফল্যের আড়ালের মানুষটি যা ধরেন তা সফল হয়। দেশের সব ধরনের ব্যবসায় তাঁর হিমালয়সম সাফল্য দেশ-বিদেশে আজ প্রশংসিত। তাঁর গাইডলাইন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এগিয়ে নিচ্ছে। কৃতজ্ঞতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরকে। কৃতজ্ঞতা কো-চেয়ারম্যান সাদাত সোবহান এবং ভাইস চেয়ারমান সাফিয়াত সোবহান ও সাফওয়ান সোবহানসহ সব পরিচালকের প্রতি। আবারও কৃতজ্ঞতা আমাদের পাঠক, গ্রাহক, বিজ্ঞাপনদাতা, হকার, বিক্রয় প্রতিনিধিসহ শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি। বাংলাদেশ প্রতিদিন আপনাদের কাগজ। আপনারা প্রথম দিন থেকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন এ কাগজটিকে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে স্মরণ করছি প্রথম দিন থেকে জড়িত বাংলাদেশ প্রতিদিনের সব সহকর্মীকে- যাঁরা ছিলেন, যাঁরা আছেন সবাইকে। স্মরণ করছি নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান, প্রধান বার্তা সম্পাদক মাশুক চৌধুরী, বিজ্ঞাপন ম্যানেজার মহিউদ্দিন আহমেদ, সম্পাদনা বিভাগের প্রধান আজহারুল ইসলামসহ যাঁরা চিরতরে চলে গেছেন দুনিয়া ছেড়ে তাঁদের সবার প্রতি। সবার শ্রম, মেধায় টিমওয়ার্কের মাধ্যমে কাগজটির আজকের অবস্থান। সবার আন্তরিকতায় বাংলাদেশ প্রতিদিন দেশ-বিদেশে বিশাল অধ্যায় তৈরি করেছে। আগামীতে এ ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে চাই। এগিয়ে নিতে চাই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে। বিশ্বাস করি, পাঠকের ভালোবাসা অব্যাহত থাকলে অবশ্যই আমরা এগিয়ে যাব। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কথা দিচ্ছি, বাংলাদেশ প্রতিদিন আপনার কথা বলবে। আপনাদের কথা বলবে। সব অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে থাকবে বলিষ্ঠ অবস্থানে।

সর্বশেষ খবর