বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা
ঢাকায় কর্মব্যস্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দুই চুক্তি সই, সমস্যা হবে না জ্বালানি তেলে

অংশীদারি বাড়াবে বাংলাদেশ-সৌদি

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

অংশীদারি বাড়াবে বাংলাদেশ-সৌদি

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন -পিআইডি

ঐতিহাসিকভাবে দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়ানো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অংশীদারিত্ব আরও বাড়ানোর বিষয়ে একমত হয়েছে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। বৈশি^ক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহের কথাও জানিয়েছে ঢাকা সফর করে যাওয়া সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বা অন্য কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের সরবরাহে কোনো সমস্যা হবে না। পাশাপাশি তার সফরে দুই চুক্তিতে সই করেছে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব।

সংক্ষিপ্ত সফরে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকা আসা সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স গতকাল সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরে সোনারগাঁও হোটেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করে দ্বিপক্ষীয় সভায় মিলিত হন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আধা ঘণ্টার বৈঠক শেষে দুই দেশের পক্ষে দুটি চুক্তিকে সই করেন দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কাস্টমস সহজীকরণ এবং বাংলাদেশের ফরেন সার্ভিস একাডেমি ও প্রিন্স সাউদ আল ফয়সাল ইনস্টিটিউট ফর ডিপ্লোম্যাটিক স্টাডিজের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে ওই চুক্তি দুটি হয়।

পরে সাংবাদিকদের সামনে এসে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যৌথ পরামর্শ সভায় তাদের ‘চমৎকার’ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সৌদি আরবের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে তারা গর্বিত। এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও তার দেশ দারুণ আশাবাদী। আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও বিস্তৃত কীভাবে করা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি আমরা। ঐতিহাসিকভাবে আমাদের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে এবং ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক নিয়ে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করছি। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুই দেশের ‘আরও অনেক কিছু’ করার আছে। এক্ষেত্রে কাজ করার জন্য ‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা’ ঠিক করার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে ‘মতৈক্যে পৌঁছেছেন’ তিনি।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের প্রায় ২৫ লাখ নাগরিকের কাজ করা এবং সেখানকার উন্নয়নযাত্রায় অবদান রাখার কথা উল্লেখ করেন প্রিন্স ফয়সাল। বাংলাদেশে সৌদি কোম্পানির বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, কয়েক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ নিয়ে কিছু সৌদি কোম্পানি ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কাজ করছে। বিনিয়োগের এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বকে আরও বিস্তৃত করতে চাই। আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিষয়ে খুবই আশাবাদী। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আরও অনেক সৌদি কোম্পানি বাংলাদেশে আসতে চায় এবং দুই দেশের সহযোগিতার সম্ভাবনাকে সামনে রেখে আমরা আমাদের অংশীদারদের একযোগে কাজ করছি।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, বলার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ভবিষ্যৎ অভীষ্টে পৌঁছানোর জন্য আমরা একে অপরের সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। আমরা নিজেদের অঞ্চলের ও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং বহুপক্ষীয় মঞ্চে একযোগে কাজ করায় বিশ্বাসী। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এবং ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের শুভেচ্ছা বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কথাও বলেন সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের সরবরাহ প্রসঙ্গ প্রশ্নের জবাবে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সল বিন ফারহান বলেন, তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে রিয়াদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন বলেন, প্রথমবারের মতো দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংলাপ হলো। সৌদি আরব নিজের দেশের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে পরিবেশবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পাঁচ হাজার গাছের চারা লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার সৌদি আরবে লাগানো হবে, বাকিটা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে। এখানে আমরা তাদের সঙ্গে অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। আমরা গাছও দিতে চাই। গাছের পরিচর্যা, রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করতে আমরা আগ্রহী। দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদারের প্রসঙ্গ টেনে আবদুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে সৌদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলেছি। এর মধ্যেই ২০টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহ দেখিয়েছে। শিগগিরই এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। হজযাত্রীদের হয়রানি বন্ধের বিষয়ে পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে আবদুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশ থেকে এবার যাঁরা হজে যাবেন, তাঁরা যেন এ দেশ থেকেই ভিসার অনুমোদন পান, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সুখের বিষয় হচ্ছে, এবার যাঁরা হজে যাবেন, তাঁদের শতভাগেরই ভিসার অনুমোদন হবে এখানে, যাতে কোনো হয়রানি না হয়। আবদুল মোমেন আরও বলেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের ২৬৫ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দিয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৮৫ শিক্ষার্থী সৌদি আরবে গেছেন। বাকিরা কেন গেলেন না, সে জন্য আমাদের কাজ করতে হবে।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে হোটেল সোনারগাঁও থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বসিলায় আরবি ভাষা ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুরে নিজ দেশের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

বাংলাদেশে সৌদি আরবের বড় ধরনের বিনিয়োগ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে সৌদি আরবের বড় ধরনের বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে সাক্ষাৎ করতে এলে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধামনমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন, সৌদি আরবের বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের দেওয়া বিদ্যমান বিভিন্ন সুবিধা কাজে লাগাবেন। কারণ বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে সৌদি বিনিয়োগকারীদের জন্য জমি বরাদ্দ করাসহ তাদের সহযোগিতা জোরদারে প্রস্তুত বাংলাদেশ। তাঁর সরকার দেশব্যাপী ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করছে। শেখ হাসিনা সৌদি আরবের সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদার করা হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারের এ সব খাতের মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষা। বৈঠকে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার দেশের অনেক কোম্পানি বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের এবং বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের সম্পর্ককে একটি ‘বন্ধুত্বের শক্ত বন্ধন’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলোতে এই বন্ধন আরও জোরদার হবে।

 সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নতুন খাত খুঁজে বের করে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও বাড়ানোকে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিবে। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে একত্রে কাজ করারও আশা করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সৌদি আরব বাংলাদেশের জনগণের হৃদয়ের একটি বিশেষ স্থানে রয়েছে। শেখ হাসিনা সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ ও যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমান আল সৌদকে তাঁর শুভেচ্ছা জানান। প্রধানমন্ত্রী মুসলিম উম্মাহর দুই পবিত্র মসজিদের খাদেম সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল্লাজিজ আল সৌদের অবদানের প্রশংসা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ মো. জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস, সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. জাভেদ পাটোয়ারি, বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ইসা ইউসাফ ইসা আল দুলাইহান বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

সর্বশেষ খবর