রবিবার, ২০ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

চলে গেলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

চলে গেলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ

সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আর নেই। ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

মৃত্যুকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রে ফেরার প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী সাহাবুদ্দীন আহমদ পরে ১৯৯৬ সালে পুনরায় রাষ্ট্রপ্রধানের পদে ফিরেছিলেন। ২০০১ সালে বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেওয়ার পর ঢাকার গুলশানের বাড়িতে অনেকটা নিভৃত জীবন যাপন করছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই সাহাবুদ্দীন আহমদ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মাসখানেক আগে তাঁকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানেই গতকাল সকাল সোয়া ১০টার দিকে সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও স্পেশাল অফিসার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান। তিনি জানান, গতকাল বিকাল ৪টায় নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় তাঁর নিজ গ্রাম পেমইতে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ সকাল ১০টায় সুপ্রিম কোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠে দ্বিতীয় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে সাবেক এই রাষ্ট্রপতিকে। সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোক জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। তাঁর মৃত্যুতে আজ সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। নব্বইয়ের আন্দোলনে স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের নাটকীয়তার মধ্যে আকস্মিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আসেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরশাদ পদত্যাগ করার পর রাষ্ট্রপতির পদে কে আসবেন, নির্বাচন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে থাকবেন- সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলো (তিন জোট) একমত হতে পারছিল না। পরে প্রধান বিচারপতিকে সেই দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়। আবার সুপ্রিম কোর্টে ফেরার শর্তে সাহাবুদ্দীন আহমদ তাতে রাজি হন। মওদুদ আহমদ উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিলে সে দায়িত্বে আসেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়লে তিনি হন রাষ্ট্রপতি। পরে তাঁর নেতৃত্বাধীন নির্দলীয় সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনের পর আবার প্রধান বিচারপতির পদে ফেরেন তিনি। তাঁর সেই ফেরার জন্য দেশের সংবিধানেও পরিবর্তন আনতে হয়েছিল। চাকরির মেয়াদ শেষে ওই পদ থেকেই অবসরে যান তিনি।

বাংলাদেশের ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার পেমই গ্রামে। তাঁর বাবার নাম তালুকদার রিসাত আহমদ। সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৪৫ সালে নান্দাইলের চণ্ডীপাশা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে আইএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ও ’৫২ সালে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন তিনি। ’৫৪ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের (সিএসপি) প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মজীবন শুরু হয় সাহাবুদ্দীন আহমদের। ’৬০ সালে প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে বদলি হন তিনি। ’৬৭ সালে ঢাকা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান সাহাবুদ্দীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭২ সালে হাই কোর্টের বিচারক নিযুক্ত হন। ’৮০ সালে তিনি আপিল বিভাগে বিচারকের দায়িত্ব পান। এর এক দশক পর ’৯০ সালের জানুয়ারিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন তিনি।

ফিরে দেখা কর্মময় জীবন : মহকুমা প্রশাসক থেকে বিচার বিভাগ, পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। বাংলাদেশের রাজনীতির ক্রান্তিকালে ঘটনাক্রমে উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। পরে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। এরপর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি হয়ে ওঠেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। বর্ণাঢ্য জীবনের শেষভাগ তাঁর কেটেছে ভীষণ একাকী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সড়ক দুর্ঘটনায় বড় মেয়ে ও তাঁর এক জামাতা মারা গেলে তিনি নিজেকে ক্রমেই গুটিয়ে নেন। শেষ দিনগুলোয় পরিবারের সদস্যরা ছাড়া কেউ তাঁর ছায়াটিও দেখেননি। সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁর কর্মজীবনে প্রথমে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মহকুমা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬০ সালের জুনে তাঁকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। তিনি ঢাকা ও বরিশালে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৬৭ সালে তিনি ঢাকা হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন। ’৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশ হাই কোর্টের বিচারক পদে উন্নীত করা হয়।

১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি হিসেবে বাংলাদেশ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর ওপর তাঁর দেওয়া রায় দেশের শাসনতান্ত্রিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক অনন্য ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তৎকালীন সরকার তাঁর সেই তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ’৭৮ সালের আগস্ট থেকে ’৮২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তাঁকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের মুখে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। ওই দিনই রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ফলে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পান। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর নেতৃত্বে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাহাবুদ্দীন আহমদের চাহিদা অনুসারে দেশের সংবিধানের ১১তম সংশোধনীটি আনা হয়। এর ফলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের পরও তিনি ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান এবং ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সাহাবুদ্দীন আহমদ আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৬ সালে। আওয়ামী লীগ ওই বছর ক্ষমতায় এসে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে। ১৯৯৬ সালের ৯ অক্টোবর তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর নেন।

বিভিন্ন ব্যক্তি সংগঠনের শোক : সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য হাসান মঞ্জুর, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রনেতা নাজমুল হক প্রধান, মোস্তফা ফারুক, নুর আহমেদ বকুল, শফি আহমেদ, বজলুর রশিদ ফিরোজ, আখতার সোবহান মাশরুর, আমিনুল ইসলাম, মনসুরুল হাই সোহন, সুজাউদ্দিন জাফর, মুখলেছউদ্দিন শাহীন, হারুন মাহমুদ, রাজু আহমেদ, রেজাউল করিম শিল্পী, সালেহ আহমেদ, জায়েদ ইকবাল খান, কামাল হোসেন বাদল, বদরুল আলম, সিরাজুমমূনীর প্রমুখ। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক নেতৃবৃন্দ ও সংগঠন তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে।

 

সর্বশেষ খবর