বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

সতর্কতা সত্ত্বেও আপনজনদের বাঁচাতে পারিনি

আবদুল্লাহ আল-নোমান

সতর্কতা সত্ত্বেও আপনজনদের বাঁচাতে পারিনি

মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিঝরা মার্চে আমরা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পাকিস্তান ভাঙার ‘ষড়যন্ত্রে’ জড়িত থাকার অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। সামরিক মার্শাল ল কোর্টে সাত বছরের কারাদন্ড, ১০ বেত্রাঘাত ও স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের রায়ে হুলিয়া ছিল আমার বিরুদ্ধে।

আমরা বুঝে গিয়েছিলাম বিজাতীয় শাসন থেকে মুক্তির একমাত্র পথ সশস্ত্র সংগ্রাম। সে প্রস্তুতি চলছিল। অসহযোগ চলছিল তখন। বোমা-রাইফেল সংগ্রহের চেষ্টা করছিলাম। আপনজনদের ভারতে নিরাপদে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতিও ছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শহর ছেড়ে রাউজানে গ্রামের বাড়ি আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। প্রথমত সেখানে গিয়ে কুন্ডেশ্বরী পরিবারের নূতনচন্দ্র সিংহসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিই। কিন্তু পরিবারটির কর্তা নূতনচন্দ্র সিংহকে দেশত্যাগে রাজি করাতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচাতে না পারাটাই অনেক বেদনার। অনেক সতর্কতা সত্ত্বেও আপনজনদের বাঁচাতে পারিনি। সে সময় রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতান্তর থাকলেও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল। এখনকার মতো ছিল না। চরম ঝুঁকি নিয়ে আমরা চট্টগ্রামের আমেরিকান সেন্টার, দাউদ করপোরেশন, আমিন জুট মিলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ‘সিম্বলিক বোম ব্লাস্ট’-এর টার্গেট নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। তখন মার্চের ২০/২১ হবে। চট্টগ্রাম কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে রাসায়নিক জার নিয়ে শহর থেকে নিরাপদে রাউজানের গহিরা গ্রামের বাড়িতে যাই। জহির রায়হানের গাড়িতে করেই রাসায়নিক বহন করি আমরা। গাড়িটি ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিলেন কাজী জাফর আহমদ। মরিস মাইনর কারটি করে কেমিক্যাল ও আর্মস রাউজানে নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যান্টনমেন্টের সামনে দিয়ে ঝুঁকি নিয়েই যেতে হয় সেখানে।

আমি তখন ন্যাপ মেনন গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির বৃহত্তর চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। এর আগেই ন্যাপ চট্টগ্রাম বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হই। তখন সভাপতি হন ব্যারিস্টার সলিমুল হক খান মিল্কি। এ ছাড়া শ্রমিক ফেডারেশন কাজী জাফর গ্রুপের সভাপতি আমি। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়ার্কের জন্য গঠিত পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির সশস্ত্র প্রস্তুতির জন্য গঠিত বিশেষ সেলের লিডার ছিলেন শামসুল আলম। আমরা তাঁর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতাম। জহির রায়হানের গাড়িটি নিয়ে রাউজান যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হই। রাউজানে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নানের সঙ্গেও দেখা হয়। ডাবুয়া পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে দেখি পাকিস্তানি পতাকা পুলিশ নিজেরাই লুকিয়ে রেখেছে। ধমক দিয়ে আমরা সে পতাকা বের করে নিই। অবশ্য বুঝতে পারি পরে পাঞ্জাবি আর্মি এলে প্রদর্শনের জন্যই তারা পতাকাটি লুকিয়ে রাখেন। এম এ হান্নানের সঙ্গে ফটিকছড়ি আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আবুর বাড়িতেও অবস্থানকালে আমাদের কথা হয়। সে সময় দলের ভিন্নতা থাকলেও একে অন্যের সঙ্গে আলোচনা, পরামর্শ হতো। গহিরা যাওয়ার আগেই আমরা রাইফেল সংগ্রহের চেষ্টা করি। সিটি কলেজের পাশে অগ্রণী ব্যাংকের গোডাউন থেকে অস্ত্র লুটের চেষ্টা চালাই। রুমঘাটার লুৎফর রহমান ও তাঁর ছেলে স্বপন এবং নওশাদ আমাদের সহযোগিতা করেন। সাধারণ মানুষ গোডাউনের লকার ভেঙে অস্ত্র নিয়ে যায়। আমরা সংগ্রহ করি চারটি রাইফেল। তা নিয়েই রাউজানে অবস্থান নিতে যাই। সেখানে গিয়ে প্রস্তুতি সভা করি। সে সময় ডাবুয়ায় দেখি সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে ফজলুল কাদের চৌধুরীর লোকজন উত্তেজনা তৈরি করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমরা সভা করি। এর মধ্যে আবার চট্টগ্রাম শহরে ফিরে আসি। দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিতে যাওয়ার পথে ফের রাউজানে যাই। এদিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাটহাজারী-রাউজানেও মর্টার শেল নিক্ষেপের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। ভীতি ছড়িয়ে যায়। আবারও গহিরা, রাউজান স্কুলের মাঠ, ডাবুয়ায় সভা করি।

গ্রেনেড রাখতে দিয়েছিলাম ফরহাদ নামে এক সহযোদ্ধাকে। তাকে আমরা ‘ক্যাপ্টেন ফরহাদ’ বলে ডাকতাম। সে মাকে দেখতে যাবে বলে হাতে গ্রেনেড নিয়ে মোটরসাইকেলে যাচ্ছিল। যাওয়ার পথে কুন্ডেশ্বরী থেকে পেট্রোল সংগ্রহের জন্য বলি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিতে ফরহাদ মোটরসাইকেল চালিয়ে কাপ্তাই রোড হয়ে বেতাগী দিয়ে বোয়ালখালী সংযোগে বাঁশখালী নিজ গ্রামে মাকে দেখতে যায়। পরে শুনি কক্সবাজারে রাজাকাররা নৃশংসভাবে তাঁকে হত্যা করেছে। কীভাবে সে কক্সবাজার গেল খবরই পাইনি। এর মধ্যে আমার মেজ ভাই আওয়ামী লীগের এমপি আবদুল্লাহ আল-হারুন ভারত থেকে চিঠি লেখেন। এক সপ্তাহ আগে আমাদের পরিবারের সবাই রামগড় হয়ে ভারত চলে যায়। আমাকে যেতে বলা হয়। রাউজানে একই এলাকায় বসবাস করে ভিন্ন রাজনৈতিক মতের অনুসারী হওয়ায় ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আমার ভাই আবদুল্লাহ আল-হারুনের বিরোধ ছিল।

এদিকে আমি ছিলাম ভিন্নধারার রাজনীতিক। মাও সে তুংয়ের ধারায় দেশের মাটিতে থেকেই সংগ্রাম করতে চেয়েছিলাম। শহর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনারা রাউজানমুখো হওয়ার খবরে সহযোদ্ধাদের নিয়ে ফটিকছড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। যাওয়ার পথে কিছু আলু ও চাল-ডাল কিনি। কুন্ডেশ্বরী যাই। সেখানে নূতনচন্দ্র সিংহকে বোঝানোর চেষ্টা করি নিরাপত্তার জন্য ভারত যেতে। তিনি কোনোভাবেই যেতে রাজি হননি। জানতে চাইলাম কেন ভারত যাবেন না? এখানে, দেশের মাটিতে আপনার শক্তি কী? কেন থাকবেন? উত্তরে বললেন, ‘আমার শক্তি ভগবান’। তাঁর বাড়ির ভিতরে থাকা ধর্মীয় শ্লোক লেখাগুলো পড়ালেন। তাঁর পুত্র সত্যরঞ্জন সিংহ ও প্রফুল্ল রঞ্জন সিংহসহ পরিবারের সবাইকে পাঠালেও শেষ পর্যন্ত তিনি যাননি। আমার বাবা-চাচাদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। আমার বাবা-চাচারা তিন ভাই ছিলেন। নূতনচন্দ্র সিংহসহ চার ভাই বলতাম। আমরা যাওয়ার সময় তাঁর পুরো পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে যাই। শুধু থেকে যান নূতনচন্দ্র সিংহ। সঙ্গে ভাতিজা মনোরঞ্জন সিংহ ছিলেন। আমরা ফটিকছড়ি গিয়ে এক রাত কাটাতেই পর দিন শুনি নূতনচন্দ্র সিংহকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে আমরা বাঁচাতে পারলাম না। এটাই চরম দুঃখের। নানুপুরে মির্জা আবু এমপির বাড়ির পাশে একটি হিন্দু বাড়িতে রাত কাটালাম। সেখান থেকে রামগড় হয়ে ভারত যাওয়ার পথে দেখি শিল্পী কল্যাণী ঘোষসহ অনেকেই লাইন ধরে বসা। মাঠের পাশে রাস্তায় বসে আছেন। ফেনী নদীর পাশে রামগড় গিয়ে দেখা হয় মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। রামগড় সদরে তাঁর সঙ্গে সেটাই জীবনের প্রথম দেখা। তাঁর দিকে তাকালাম। আগে নাম শুনেছিলাম কেবল। তিনিও সাবরুম পার হয়ে হরিণা ক্যাম্পে যান। আমরাও সাবরুম হয়ে ওপারে আশ্রয় নিই।

লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান। অনুলিখন : রিয়াজ হায়দার চৌধুরী।

 

সর্বশেষ খবর