মঙ্গলবার, ২৯ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

বেরিয়ে আসছে রাঘববোয়ালদের নাম

টিপু ও প্রীতি হত্যা মামলায় সাত দিনের রিমান্ডে মাসুম

সাখাওয়াত কাওসার

বেরিয়ে আসছে রাঘববোয়ালদের নাম

চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন রাজধানীর শাহজাহানপুরে জোড়া খুনের ঘটনায় গ্রেফতার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ। তার জবানিতে বেরিয়ে আসছে অনেক রাঘববোয়ালের নাম। তাদের কেউ কারাবন্দি, কেউ বা বিদেশ পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী। কিন্তু এখনই তার দেওয়া সব তথ্য আমলে নিচ্ছেন না তদন্তসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলেছেন, আকাশের দেওয়া প্রতিটি তথ্যই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নানাভাবে যাচাই-বাছাই করছেন। জড়িত থাকার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়ার পরই তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তবে আকাশের প্রধান সহযোগী মোটরসাইকেল চালক ও অস্ত্র সরবরাহকারীকে গ্রেফতারে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছেন তাঁরা। এদিকে, জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার অন্যতম কারণ যে আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ তা এরই মধ্যে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের বাইরেও নৃশংস এ ঘটনা নিয়ে একাধিক সংস্থা মাঠে কাজ করছে। এ ছাড়া আকাশকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল আদালতের নির্দেশে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আকাশ নিজেই গুলি করেছেন বলে আমাদের কাছে স্বীকার করলেও কার নির্দেশে, কী কারণে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছেন সেসব বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দেননি। শুধু মামলা থেকে অব্যাহতির কারণে এ মিশনে অংশ নেন বলে দাবি করলেও তা যৌক্তিক মনে হয় না। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। এ ছাড়া মোটরসাইকেল চালক ও অস্ত্র সরবরাহকারীকে গ্রেফতার করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’

একাধিক সূত্র বলছেন, শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ কেন, কার নির্দেশে হত্যা করেছেন সেসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। উত্তরে যেসব তথ্য দিয়েছেন সেসব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি কর্মকর্তাদের। তাঁরা জানতে পেরেছেন রিয়াজ মিল্কি হত্যাকান্ডের পর থেকে দলে এবং এলাকায় প্রভাব হারিয়ে ফেলেন নিহত টিপু। অনেকটা একঘরে হয়ে যান। তবে সবশেষ নির্বাচনের আগে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে তৎকালীন প্রভাবশালীরা কেবল লোক দেখানোর জন্যই কিছুদিন তাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে সামনের কাতারে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে নির্বাচনের পরই টিপুকে আগের অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়। আবারও একঘরে করে রাখা হয়। নিজের কর্মীরাও তাকে এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ক্যাসিনো অভিযান টিপুর জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসে। মরে যাওয়া গাছে রীতিমতো পাতা গজাতে শুরু হয়। দলে এবং এলাকায় আবারও গুরুত্ব বাড়তে থাকে তার। মতিঝিল আওয়ামী লীগে আগামীর কাউন্সিলে নিজেকে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণাও দিয়েছিলেন। টিপুর কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের প্রতিটি কর্মকান্ডের তদন্ত করছেন সংশ্লিষ্টরা। আকাশের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে অনেকটাই মিল পেয়েছেন তাঁরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যেহেতু কাটআউট সিস্টেমে এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, কাজেই পরবর্তী ধাপগুলোয় যারা রয়েছেন তাদের জীবনহানির শঙ্কা রয়েছে। এ নিয়েও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। যাতে পরবর্তী ধাপের অপরাধীরা মূল পরিকল্পনাকারীর মাধ্যমে আক্রান্ত না হন।

তিনি আরও বলেন, মতিঝিলের আধিপত্যের দ্বন্দ্বে খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা টিপু আর খুন করেছেন গোড়ান এলাকার বাসিন্দা। এ হত্যার পেছনে অনেক শক্তিশালী ব্যক্তি রয়েছেন। যারা পরিকল্পিতভাবে এ হত্যার ছক তৈরি করে শুটার আকাশসহ অনেককেই ব্যবহার করেছেন, যার কারণে মোটিভ নিশ্চিত হওয়ার জন্য হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল চালক, মোটারসাইকেল ও অস্ত্র সরবরাহকারীকে শনাক্ত ও গ্রেফতার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারলে পেছনে থাকা তৃতীয় স্তরের পরিকল্পনাকারীদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যাবে। তার পরই হত্যার মোটিভ জানা যাবে।

জানা গেছে, আকাশ আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম নিখুঁত শুটার। ১৬-১৭ বছর বয়স থেকেই তিনি অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। ২০০৭ সালে সবুজবাগ থানা ছাত্রদল নেতা শরীফ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আকাশ। পরে কাকরাইল কর্ণফুলী মার্কেটের সামনে ছাত্রদল নেতা হাবিব হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সম্মুখ সারিতে ছিলেন। আরেক ছাত্রদল নেতার ভাড়াটে হয়ে তিনি হাবিবকে গুলি করতে গিয়েছিলেন বলে তদন্তে উঠে এসেছিল। তার বিরুদ্ধে অন্তত চারটি মামলার তথ্য রয়েছে। এই শুটারের সঙ্গে প্রায় ১৫ বছর ধরে তার পরিবারের সদস্যদের যোগাযোগ নেই। স্বল্প ও মিষ্টভাষী এই শুটার নিজেকে সব সময় হাইড করে রাখতে পছন্দ করেন। বয়োজ্যেষ্ঠদের সব সময় মান্য করে চলেন। তাকে যারা চেনেন সবাই নম্র-ভদ্র হিসেবেই মনে করেন। তিনি মূলত মতিঝিলকেন্দ্রিক আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম শুটার। টিপুকে হত্যার আগের দিন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন পাঁচ-সাত দিন বাসায় যাবেন না। হত্যাকান্ডের পর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তার স্ত্রীই তাকে শনাক্ত করেন। তারপর তার বিষয়ে তথ্য পান। ডিবির কর্মকর্তারা রবিবার পুলিশের সহায়তায় বগুড়ার একটি অখ্যাত আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেফতার করেন তাকে।

সূত্র বলছেন, নিখুঁত পরিকল্পনায় টিপু হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। কাটআউট পদ্ধতিতে অন্তত চার স্তরের লোকজন জড়িত। প্রথম স্তরে রয়েছেন শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও অজ্ঞাত মোটরসাইকেল চালক। দ্বিতীয় স্তরে আছেন অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সরবরাহকারী। তৃতীয় স্তরে সমন্বয়কারী। আর সবশেষ চতুর্থ স্তরে মূল পরিকল্পনাকারী বা মাস্টারমাইন্ড।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর