বৃহস্পতিবার, ৩১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

মাদক ও অভাবে বাড়ছে অপরাধ

পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধের চিত্র সারা দেশে ভয়াবহ, বিশেষজ্ঞদের উৎকণ্ঠা

মাহবুব মমতাজী

মাদক ও অভাবে বাড়ছে অপরাধ

মাদকের ভয়াল ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে দেশ। বাড়ছে নানা অপরাধ। এ মাদকাসক্তরাই রাজধানীতে একের পর এক ছিনতাই আর খুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, শুধু মাদকের জন্য নয়, অনেকে অভাবে পড়েও ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন। পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধের এমন চিত্র ভয়াবহ। এ নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার কথাও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে গতকাল পুরান ঢাকার ইংলিশ রোডে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সূচনা শোভা। ছিনতাইকারীরা তাঁর গলার হার ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যায়। রিকশায় যাওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র বলছেন, গত এক বছরে সারা দেশে পারিবারিক সহিংসতায় খুনোখুনির ঘটনা ৫০টির বেশি। এর মধ্যে স্বামীর হাতে স্ত্রী, ভাইয়ের হাতে ভাই, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সন্তানের হাতে বাবা কিংবা বাবার দ্বারা সন্তান খুনের ঘটনা রয়েছে।

এদিকে পুলিশ সদর দফতরের ওয়েবসাইটে ২০১৯ সাল থেকে হত্যাসহ অপরাধের তথ্য প্রকাশ  বন্ধ রয়েছে। সূত্র বলছেন, বছরে ঢাকায় গড়ে ২৫০টি হত্যার ঘটনা ঘটে। আর সারা দেশে প্রায় ৪ হাজার। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানার জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির বিভিন্ন মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় খুন, চাঁদাবাজি, গাড়ি চুরি ও দস্যুতার মতো অপরাধ বেড়েছে। কমেনি ছিনতাইয়ের ঘটনাও। এ বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে খুন হন নয়জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের ঘটনা ১২টি। এর মধ্যে পাঁচটি খুনের ঘটনাই মিরপুরে। খুনের সঙ্গে ঢাকায় মোটরসাইকেলসহ গাড়ি চুরির ঘটনাও বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এ রকম ৩৬টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারিতে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চুরির মামলা হয়েছিল ৩১টি। চাঁদাবাজির ঘটনায় গত দুই মাসে ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৬টি। গত মাসে নয়টি ও জানুয়ারিতে সাতটি। তবে অনেকে হয়রানি এড়াতে এবং চাঁদাবাজদের হুমকির কারণে মামলা করতে চান না। পুলিশ বলছে, করোনার কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় চুরি ও দস্যুতা কম ছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আগের মতোই রাজধানী কর্মব্যস্ত। এ ছাড়া ঢাকায় মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছেন মাদকসেবীরা। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় জানুয়ারিতে পাঁচটি ও ফেব্রুয়ারিতে আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে। তবে ডিএমপির এ মামলার তথ্যে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। কারণ ছিনতাইয়ের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে মামলা করেন না। পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি মোখলেসুর রহমান এ প্রতিবেদককে জানান, কখনো কখনো কিছু অপরাধ এমনভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তা বিশ্লেষণ করা যায় না। এসব অপরাধ দমনে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে এখন ছিনতাই বেড়েছে। এটি সংকেত দিচ্ছে যে ভবিষ্যতে এটি বাড়বে। তবে মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত বেশি। মাদকাসক্তরা ছিনতাই ছাড়াও চুরি, ডাকাতি, খুন ও পারিবারিক সহিংসতার মতো বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া কর্মহীনতা এবং বেকারত্বও নানা অপরাধ বাড়ার কারণ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে রাজধানীর মৌচাকের অফিস থেকে মেরুল বাড্ডার বাসায় ফিরছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী খন্দকার পলাশ। রিকশায় বাসায় ফেরার পথে রাত ৮টার দিকে রামপুরা বাজার এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন তিনি। পুলিশের কাছে গেলে ঝামেলা হতে পারে। আবার ফোন উদ্ধার হবে কি না সে নিশ্চয়তাও নেই। তাই থানায় গিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি তিনি। ফেব্রুয়ারিতে মাসিক অপরাধ পর্যালোচনা নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সভা করে। সভায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থানাভিত্তিক অপরাধীদের তালিকা তৈরি করে দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। ডিএমপির উপ-কমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) ফারুক হোসেন এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা দেখছি ঢাকায় ভাসমান মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। যখন মাদক কেনার জন্য তাদের পকেটে টাকা থাকে না, তখনই তারা মানুষের যা কিছু পায় তা-ই ছিনতাই করে। আবার কিছু আছে পেশাদার ছিনতাইকারী। এদের এবং মাদকসেবীদের তৎপরতায় সম্প্রতি ছিনতাই বেড়ে গেছে।’ বিশ্লেষকদের অনেকে অপরাধের কারণ হিসেবে বিচারহীনতা, আর্থসামাজিক বৈষম্য, কর্মহীনতা, পুলিশের ব্যর্থতাসহ নানা বিষয় সামনে আনেন। তাঁরা মনে করেন অপরাধীরা বারবার ধরা পড়ে কারাগারে যায়। মামলা, তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার দুর্বলতায় তারা বেরিয়ে আবার অপরাধে জড়ায়। আর ঢাকায় সহজে অপরাধে জড়ানোর সুযোগ বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা গেলে নানা অপরাধ দমন করা যেত। সব অপরাধের নেপথ্যে কোনো না কোনোভাবে মাদকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। কখনো কর্মহীনতার কারণেও অপরাধের ঘটনা ঘটে। তবে দেখা যায়, যে অপরাধী সে একাধিক অপরাধ করছে। আমরা তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছি না। এটা আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার এক ধরনের দুর্বলতা বলা যায়।’ ডিএমপির ২০২১ সালে বিভিন্ন অপরাধে মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অন্যগুলোর তুলনায় মাদক ও চোরাচালানের মামলা বেশি। রাজধানীর যেসব এলাকায় নিম্ন আয় ও ভাসমান মানুষের বসবাস বেশি, সেখানে অপরাধ ঘটে বেশি। এর বহুমুখী কারণ রয়েছে। তবে বড় কারণ দারিদ্র্য ও অপরাধপ্রবণতা। ডিএমপির আট বিভাগে ২০২১ সালে অপরাধের মামলা হয়েছে ২৭ হাজার ৪৬১টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক নিয়ে। এরপর রয়েছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা। ডিএমপি এলাকায় গত বছর ১৬৬টি খুনের ঘটনা ঘটে, যা আগের বছরের চেয়ে ৫৩টি কম। বিভিন্ন অপরাধে ২০২১ সালে সব মিলিয়ে গ্রেফতার করা হয় ৫০ হাজারের মতো ব্যক্তিকে। আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ৪২ হাজার ৩৬৯। ওই বছর ডিএমপিতে ২২ হাজার ৬৭৩টি মামলা হয়। ঢাকা মহানগরে গত বছর যে ১৬৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ৩৫টি হয়েছে ডিএমপির ওয়ারী বিভাগে, ২৬টি মিরপুরে, ২৪টি গুলশানে, ১৯টি মতিঝিলে, ১৭টি করে উত্তরা ও তেজগাঁওয়ে, লালবাগে ১৫টি এবং রমনায় ১৩টি। শুধু ২০২১ সাল নয়, আগের বছরগুলোর অপরাধপ্রবণতা বিশ্লেষণেও ওয়ারী বিভাগ, মিরপুর ও গুলশানে খুনের ঘটনা বেশি দেখা গেছে। ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছিল মিরপুর ও গুলশান বিভাগে। ওই বছর এ দুই বিভাগে ৩৩টি করে খুনের ঘটনা ঘটে। আর ওয়ারীতে সংখ্যাটি ছিল ৩২। ডিএমপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপরাধের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে তেজগাঁও বিভাগের আওতাধীন এলাকায়। এ এলাকায় ধর্ষণ, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, সিঁধেল চুরি, গাড়ি চুরি ও মাদক উদ্ধারের ঘটনা বেশি ঘটেছে। তেজগাঁও বিভাগের অধীন থানা ছয়টি হলো- তেজগাঁও, শিল্পাঞ্চল, হাতির ঝিল, শেরেবাংলানগর, আদাবর ও মোহাম্মদপুর। এ বিভাগের অধীনে মোহাম্মদপুরের বছিলা ও বেড়িবাঁধ, আদাবর ও শেরেবাংলানগর থানা এলাকায় বস্তি রয়েছে। সেখানে ভাসমান ও নিম্ন আয়ের লোকজন বেশি বসবাস করে। ২০২১ সালে তেজগাঁও বিভাগের থানা এলাকায় ৬৩টি গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটেছে, যা ডিএমপির সব বিভাগের তুলনায় সর্বোচ্চ। মাদক উদ্ধারের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৮৩১টি মামলা হয়েছে এ বিভাগে। সর্বাধিক সাতটি ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে এ বিভাগে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও সবচেয়ে বেশি ঘটেছে তেজগাঁও বিভাগে, যার সংখ্যা ২৭।

রাজধানীর দক্ষিণখান কাওলার নামাপাড়ার বাসিন্দা আপন মিয়া। পেশায় সবজি ব্যবসায়ী আপন মিয়া ও তাঁর সঙ্গী নজরুল ইসলাম কারওয়ান বাজারে যাবেন বলে ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাতে বিমানবন্দর এলাকার কাওলার ফুটওভার ব্রিজের পুব পাশে অপেক্ষা করছিলেন। একটা সময় তাঁরা একটি পিকআপ ভ্যানে উঠে বসেন। ওঠার পর পিকআপে থাকা মুসা ও রফিক ছুরি ধরেন আপন ও নজরুলের বুকে। এ সময় ডাকাত দলের প্রধান সজল তাঁদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন এবং আপন মিয়াকে ধাক্কা দিয়ে পিকআপ থেকে ফেলে দেন। খানিক দূরে গিয়ে নজরুলকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার ওপর ফেলে চলে যায় ডাকাত দল।

ডাকাতির এমন একটি ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানবন্দর সড়কে একের পর এক বাস-ট্রাক চলছে। এ সময় একটি পিকআপ ভ্যান থেকে একজনকে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি সড়কেই পড়ে ছিলেন। ওই যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার পরও সেখানে তাঁকে উদ্ধারে কোনো গাড়ি থামেনি। ওই ঘটনায় আপন মিয়া মারা যান এবং বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জানুয়ারি রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের চনপাড়া বটতলা মোড় থেকে ডাকাত দলের নেতা সজলসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এদের মধ্যে গ্রেফতার সজীব জানিয়েছিলেন, তিনি গাড়ি চালাতেন। করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েন। কেউই তাকে কাজ দিচ্ছিল না। তার স্ত্রী ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা। দুই দিন না খেয়ে ছিলেন। এর মধ্যে এক দিন শুধু ভাত খেয়েছিলেন। এমন অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে রাতে সজলের সঙ্গে যোগ দিয়ে ছিনতাই করতে বের হন। তবে আপনকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা তাদের ছিল না।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর