শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

থামছেই না মানব পাচার

বাংলাদেশিদের পাশাপাশি রোহিঙ্গারাও টার্গেটে, তিন মাসে লিবিয়া থেকে ফিরল ৪০০ ঝুলে আছে ৬ হাজার মামলা, চার্জশিট থেকে শীর্ষ মানব পাচারকারীর নাম বাদ

মাহবুব মমতাজী

থামছেই না মানব পাচার

থামছেই মানব পাচারের ঘটনা। নানা কৌশলে এমন ঘটনায় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে সব মহলে। তবে বিচারকাজের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন পাচারকারী ও তাদের নিয়োজিত দালালরা। আর পাচারের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও রয়েছে দুর্বিষহ যন্ত্রণায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানব পাচার বন্ধ না হওয়ার নেপথ্য কারণ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৬ হাজারের বেশি মামলা ঝুলে আছে। যার বিচার চলছে বছরের পর বছর ধরে। সম্প্রতি পাচারের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে ২০১ জন রোহিঙ্গা উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া পাচারের শিকার ১৬ বাংলাদেশি গত ৩০ মার্চ গ্রিস থেকে ফিরেছেন। চলতি বছরের গত তিন মাসে ৪০০-এর বেশি ফিরেছেন শুধু লিবিয়া থেকে। এদিকে মানি লন্ডারিংয়ের এক মামলার চার্জশিট থেকে অভিযুক্ত শীর্ষ একজন মানব পাচারকারীর নাম বাদ দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, ৮টি রুট ব্যবহার করে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষদের প্রতিবেশী দেশে পাচার করা হচ্ছে। রুটগুলো হলো- চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, সাতক্ষীরার দেবহাটা, যশোরের বেনাপোল,  লালমনিরহাটের পাটগ্রাম ও দহগ্রাম, জয়পুরহাটের বস্তাকর, মৌলভীবাজারের পশ্চিম শিলুয়া, কক্সবাজার টেকনাফের জালিয়াপাড়া এবং কুমিল্লার গোলাবাড়ী সীমান্ত দিয়ে পাচারের ঘটনা ঘটে। ছোট ছোট রুটের মধ্যে আছে বান্দরবানের সীমান্ত এলাকা, সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে পুলিশের তদন্ত সংস্থা সিআইডি। সংস্থাটির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান বলেন, মানব পাচার প্রতিরোধে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আমরা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছি। আর বিচারে শাস্তি নিশ্চিত হয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে।

মানবাধিকার সংগঠন রাইটস যশোর নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক বলেন, মামলার শাস্তি না হওয়ার জন্যই মানব পাচার বন্ধ হচ্ছে না। শুধু ভারতে প্রতি বছর হাজারের বেশি অবৈধভাবে পাচার হয়। আর মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে পাসপোর্টের মাধ্যমে পাচারের ঘটনা ঘটছে। তবে সীমান্তের যেসব রুট দিয়ে পাচার হয়, সেসব রুট অনেক টাকায় লোকচক্ষুর আড়ালে ডাক ওঠে। এতে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও জড়িত।

দীর্ঘ সময় বিচার ঝুলে থাকার বিষয়টি কক্সবাজারের রামু উপজেলার একটি ঘটনায় ফুটে উঠেছে। ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরীকে নেপালে ভালো চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিয়েছিল মানব পাচারকারীরা। ২০১৪ সালের আগস্টে তাদের খপ্পরে পড়ে ওই কিশোরীর ঠাঁই হয় খুলনার একটি যৌনপল্লীতে। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। পাঁচ মাস পর ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিন মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে রামু থানায় একটি মামলা করে মেয়ের পরিবার। ওই বছরের অক্টোবরে তিনজনকে আসামি করে চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ। এখন পর্যন্ত বিচার দূরে থাক, আসামিদের কেউ ধরা পড়েননি। মামলাটির বিষয়ে ওই কিশোরীর আইনজীবী অ্যাডভোকেট শামসুল হক জানান, ওই মামলা একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। মামলাটি এখনো সাক্ষী পর্যায়ে আছে। দীর্ঘদিন মামলাটি বিচারাধীন থাকায় ভুক্তভোগী হতাশ হয়ে আর মামলার খোঁজ রাখেন না। মামলার সাক্ষীদেরও পাওয়া যায় না।

পুলিশ সদর দফতরের গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের মানব পাচার মামলার পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ জুন থেকে গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৭ হাজার ১৭৯টি মামলা হয়েছে। এর ভুক্তভোগীর সংখ্যা ১২ হাজার ৮০৭ জন। এদের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ১০ হাজার ৮৮ জনকে। এদের পাচারে সম্পৃক্ততায় ২৯ হাজার ৫৩০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর গ্রেফতার করা গেছে ১৩ হাজার ৫৬২ জনকে। এসবের মধ্যে গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৮১২টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। সাজা হয়েছে ৪০৯ জনের। খালাস পেয়েছেন ১ হাজার ৭২১ জন। মৃত্যুদন্ড হয়েছে আটজনের। যাবজ্জীবন হয়েছে ২৯৯ জনের।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের গত বছরের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত বছরে বিভিন্ন থানায় মানব পাচার সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৫৫৪টি। চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ৩৬৬টি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৪০টির। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের হিসাবে তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৯৫টি। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মানব পাচারের মামলা হয়েছে ৪৮টি। গত বছরে কোনো মামলাতেই কোনো আসামির শাস্তি হয়নি। বরং খালাস পেয়েছেন পাঁচজন।

এদিকে কক্সবাজারে নোঙর নামে একটি এনজিও দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের মানব পাচারের মামলা নিয়ে কাজ করছে।

সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১২ সালের পর থেকে কক্সবাজারে মানব পাচার বেড়ে গেছে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কক্সবাজার উপকূল দিয়ে মানব পাচার বন্ধ ছিল। ২০১৯ সালের শুরু থেকে সমুদ্রপথে মানব পাচার পুনরায় শুরু হয়েছে।

জানা গেছে, গত ২৫ মার্চ সমুদ্রপথে বাংলাদেশ থেকে ৫৮ জনকে মালয়েশিয়ায় পাচারের সময় বঙ্গোপসাগর থেকে মানব পাচারকারী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করেছে র‌্যাব। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার শামলাপুর গভীর সমুদ্র থেকে একটি ট্রলারসহ তাদের আটক করা হয়। এ সময় উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ২৪ জন নারী, ১১ শিশু ও ২৩ জন পুরুষ। এর মধ্যে ৫৭ জনই রোহিঙ্গা ও একজন বাংলাদেশি নাগরিক। নোঙরের নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ জানান, সচেতনতার অভাব এবং আইনশৃঙ্খলার কড়াকড়ির অভাবে সাগরপথে মানব পাচারকারীরা ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

সেই গডফাদারকে বাদ দিয়ে সিআইডির চার্জশিট : মোহাম্মদ আছেম নামে এক ব্যক্তিকে সাগরপথে মানব পাচারের গডফাদার বলে অভিযুক্ত করে সিআইডি। পরে মামলার চার্জশিট থেকে সেই গডফাদারকেই বাদ দিয়েছে সংস্থাটি। ওই ব্যক্তির বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে।

তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ৩ মে রাজধানীর বনানী থানায় মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করেন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক খান। মামলায় আসামি করা হয় আরিফুজ্জামান আকন্দ, মোহাম্মদ আছেম, তার মা খতিজা বেগম, ওসমান সরোয়ার এবং মো. একরামকে। ২০২০ সালের ৯ আগস্ট আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ২০ আগস্ট আদালত তা গ্রহণ করে। ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট আছেমকে এবং একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর একরামকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে সিআইডি। দুজনই এখন জামিনে আছেন। এ মামলাটি এখনো বিচারাধীন আছে বলে আদালত সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার সাইদুর রহমান খান বলেন, তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলাটির তদন্ত হয়েছে অন্য ইউনিটে। আর মানব পাচারসংক্রান্ত মামলাগুলোর তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে তা এখন জানা নেই। তবে দেখে বলতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর