শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ক্লাবে কিলিং মিশনের পরিকল্পনা মাস্টারমাইন্ডসহ আটক ৪

টিপু ও প্রীতি হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফরান জামাল প্রীতি হত্যায় জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার আরফান উল্লাহ ওরফে দামালকে রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল রিমান্ড আবেদন করে তাকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত এক দিন মঞ্জুর করে। এর আগে বুধবার রাতে রাজধানীর কমলাপুরের কালভার্ট রোড এলাকা থেকে একটি পাকিস্তানি রিভলবার, দুই রাউন্ড গুলিসহ দামালকে গ্রেফতার করা হয়। ডিবির দাবি, টিপুকে  হত্যার দুই মাস আগে কমলাপুরের রুপালি যুব উন্নয়ন সংঘ ক্লাবে যে বৈঠক বসেছিল সেখানেও উপস্থিত ছিলেন দামাল।

গ্রেফতারকৃতদের তথ্যের বরাত দিয়ে তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিপু কিলিং মিশনের দুই মাস আগে রুপালি যুব উন্নয়ন সংঘ ক্লাবে বৈঠক করা হয়। বৈঠকে অংশ নেন আন্ডারওয়ার্ল্ডের প্রভাবশালী তিনটি সন্ত্রাসী গ্রুপের (জিসান, ফ্রিডম মানিক ও বিকাশ-প্রকাশ) ছয় প্রতিনিধি। যাদের মধ্যে ছিলেন বোচা বাবু হত্যা মামলার আসামি মূসা, কিলিংয়ে অংশ নেওয়া মোল্লা শামীম ও ফ্রিডম মানিকের ক্যাশিয়ার মারুফ। পরিকল্পনার পর কিলিং মিশনে মূল শুটার আকাশের সহযোগী হিসেবে কাজ করা মোল্লা শামীম সবাইকে আকাশের কথা জানিয়ে বলেন, ভালো একজন শুটার আছেন যিনি সফলভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। শামীমের সঙ্গে শুটার আকাশের ভালো সম্পর্ক থাকায় শামীমই আকাশকে মূসার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এ সময় আকাশের নামে পাঁচটি মামলা থাকার বিষয়টি উঠে আসে। কিলিং মিশনের দেড় মাস আগে আকাশকে সিএমএম কোর্টে নিয়ে যান শামীম। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন মূসা। পরে এক আইনজীবীর উপস্থিতিতে আকাশের নামে থাকা পাঁচটি মামলা থেকে অব্যাহতি পাইয়ে দেওয়ার জন্য ৭ লাখ টাকায় চুক্তি হয়। কিলিং মিশন সফল হলেই আকাশকে মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ওই টাকা দেওয়ার কথা ছিল মূসার। এ হত্যার নেপথ্যে কাজ করেছে বৃহত্তর মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি, ক্রীড়া পরিষদের টেন্ডার ও কোরবানির ঈদে গরুর হাটের নিয়ন্ত্রণ। মূলত ঢাকা মহানগরী দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট আগে মতিঝিলের টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ এসব কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিতেন। ক্যাসিনোকান্ডে সম্রাট কারাগারে যাওয়ার পর নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে মতিঝিলের সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। এ সময় সম্রাটের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত গুলিতে নিহত টিপুর হাতে সব ক্ষমতা চলে যেতে পারে আশঙ্কা করেন আন্ডারওয়ার্ল্ড গডফাদাররা। ক্রীড়া পরিষদের টেন্ডার আন্ডারওয়ার্ল্ড এজেন্টরা না পাওয়ার পেছনে টিপুর হাত আছে বলেও ধরে নেওয়া হয়। ফলে বিদেশে পলাতক আন্ডারওয়ার্ল্ড গডফাদার জিসান, ফ্রিডম মানিক ও দুই ভাই বিকাশ-প্রকাশের ধারণা জন্মায় টিপুকে হত্যা করতে পারলে পথের কাঁটা শেষ। তাদের এজেন্টরা সব ধরনের কার্যক্রম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। আন্ডারওয়ার্ল্ড গডফাদারদের নির্দেশে টিপুকে হত্যার মিশন সফল করতে সব ধরনের সমন্বয় করেন এজিবি কলোনি এলাকার নাম করা শুটার মূসা। এ মূসার সঙ্গে আবার টিপুর দীর্ঘদিনের রেষারেষি চলছিল। কারণ বোচা বাবু হত্যা মামলার সব ধরনের খরচ চালাতেন টিপু। বোচা বাবুর বাবা আবুল কালামও টিপুর ঘনিষ্ঠ লোক। হত্যার সময় টিপুর গাড়ির পেছনেও বসা ছিলেন তিনি। বোচা বাবু হত্যা মামলার আরেক আসামি ফারুকেরও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে এ হত্যায়। কানা ফারুক একবার ২ কোটি টাকার টেন্ডার পেয়ে সে কাজের ৩০ লাখ টাকা নিয়ে টিপুর কাছে যান। কিন্তু টিপু ৩০ লাখ টাকার বিনিময়েও আপসরফা করতে রাজি হননি। কারণ বোচা বাবুর বাবা আবুল কালাম টিপুর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় টিপু ভেবেছিলেন একমাত্র ছেলে হত্যার বিচার অন্তত পান আবুল কালাম। আপসরফা না করায় ফারুক-মূসাসহ অন্য সব আসামিই ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। পাশাপাশি যুবলীগ নেতা মিল্কি হত্যার রেশও টিপু হত্যায় ভূমিকা রেখেছে। বোচা বাবু হত্যার আসামি কানা ফারুক ও কাইল্লা পলাশ ছিলেন মিল্কি হত্যা মামলার বাদীপক্ষের লোক। মিল্কি হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তারা টিপুসহ বেশ কয়েকজনকে সন্দেহ করতেন। টিপু ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় তাদের ক্ষোভ জন্ম নেয়। মূলত পথের কাঁটা সরাতে আন্ডারওয়ার্ল্ড গডফাদাররা বোচা বাবু ও মিল্কি হত্যার ঘটনায় টিপুর প্রতি বিক্ষুব্ধ গ্রুপটিকে ব্যবহার করেছেন। সূত্র জানান, গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা মারুফ মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম গডফাদার ফ্রিডম মানিকের ক্যাশিয়ার। বৃহত্তর মতিঝিল এলাকায় ফ্রিডম মানিকের নামে যে টাকা উঠত সব জমা হতো মারুফের কাছে। চাঁদার একটি অংশ তিনি হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পলাতক ফ্রিডম মানিকের কাছে পাঠান। আরেকটি অংশ চাঁদা ওঠানোর কাজে নিয়োজিত সদস্যদের দেন। এমনকি পাকিস্তানি অস্ত্রসহ গ্রেফতার দামালকে যুবলীগের পদ পাওয়ার জন্য শোডাউন করতে যা খরচ লাগত সবই মারুফ দিতেন। মারুফ শাহজাহানপুর মসজিদের তিন তলায় ব্যাংক এশিয়ার এজেন্ট ব্যাংকিং খুলেছেন বলেও জানা গেছে। ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, ‘টিপু হত্যার আগে দামালসহ কয়েকজন কমলাপুরের একটি ক্লাবে বৈঠক করেছিলেন। ইতোমধ্যে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া মারুফ ও শামীম নামে দুজনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বাকিদেরও নাম পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। দামালকে স্থানীয় যুবলীগ নেতা বলে সবাই চেনেন। তার বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে। সে মামলায় রিমান্ডে আনা হয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে দামাল স্বীকার করেছেন, এ হত্যায় যাদেরই নাম এসেছে সবার সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও মোটরসাইকেল এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রিমান্ডে থাকা মূল শুটার আকাশের দেওয়া তথ্যানুসারে সেগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি দামালের কাছে পাওয়া অস্ত্রটি হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে কি না তা-ও যাচাই করা হচ্ছে। কেননা ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত গুলির খোসা অনুযায়ী হত্যার সময় দুটি অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাকআপ পার্টি হিসেবে কেউ ছিল কি না, থাকলে তারা কারা এসব তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে বাসায় যাওয়ার পথে শাহজাহানপুর থানার আমতলায় গুলি করে টিপুকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় প্রীতি নামে এক ছাত্রীও নিহত হন। আহত হন টিপুর ড্রাইভার মুন্না। এ ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন টিপুর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ডলি। রবিবার বগুড়া থেকে এ ঘটনায় শুটার মাসুম ওরফে আকাশকে গ্রেফতার করে ডিবি। পরদিন তার সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। এরপর বুধবার রাতে রাজধানীর কমলাপুরের কালভার্ট রোড এলাকা থেকে অস্ত্র, গুলিসহ দামালকে গ্রেফতার করা হয়।

মাস্টারমাইন্ডসহ চারজন গ্রেফতার : শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যা ঘটনার অন্যতম মাস্টারমাইন্ডসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে র?্যাব। গত রাতে র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, আজ (শুক্রবার) রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নাম না জানালেও তাদের মধ্যেই অন্যতম মাস্টারমাইন্ড রয়েছেন বলে জানানো হয়। পরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হবে বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর