শনিবার, ২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

গভীর সংকটে শ্রীলঙ্কা

খাদ্য ও নিত্যপণ্যের জন্য দীর্ঘ লাইন, জ্বলছে না বিদ্যুৎ বাতি, বন্ধ ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্রপতি ভবনে বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলা গুলি

প্রতিদিন ডেস্ক

গভীর সংকটে শ্রীলঙ্কা

কারফিউ তুলে নেওয়ার পর গতকাল শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ -এএফপি

গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। একই সঙ্গে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে একক অর্ধ রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি গণবিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা গত বৃহস্পতিবার রাতে রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকারি বাসভবনে পর্যন্ত হামলা চালায়। নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। জারি হয়েছে কারফিউ। পাশাপাশি ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

গণমাধ্যমগুলোর খবর অনুযায়ী, খাদ্য তেল ও বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষের বাসভবনের সামনে ব্যাপক বিক্ষোভে অংশ নেয় জনতা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়েছে। এরপর সকাল পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। সে অনুযায়ী গতকাল সকালে কারফিউ তুলে নেওয়া হলেও পুলিশ গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে। সকাল পর্যন্ত পাওয়া খবরে জানা যায়, বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় পুলিশ নারীসহ ৪৫ জনকে আটক করেছে।

শ্রীলঙ্কার সংবাদপত্র ডেইলি মিরর জানায়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য সরকারকে দায়ী করে রাষ্ট্রপতির বাসভবনে হামলার চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ বেধে যায়। শেষ পর্যন্ত টিয়ার শেল আর জলকামান ব্যবহার করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।

এরপর রাতেই কলম্বো উত্তর, দক্ষিণ, কলম্বো সেন্ট্রাল, নুগেগোদা, মাউন্ট লাভিনিয়া এবং কেলানিয়া এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। পুলিশের মুখপাত্র নিহাল থালডুয়া বলেন, বিক্ষোভের সময় সেনাবাহিনীর একটি বাস, জিপ, থ্রি-হুইলার, দুটি ট্রাফিক মোটরসাইকেলসহ বেশ কয়েকটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। বিক্ষোভে পুলিশ, স্পেশাল টাস্কফোর্সের (এসটিএফ) সদস্য এবং সাংবাদিকসহ প্রায় ৫০ জন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। প্রেসিডেন্সিয়াল মিডিয়া বিভাগ (পিএমডি) দাবি করেছে, বিক্ষোভের নেপথ্যে একটি চরমপন্থি গোষ্ঠী।

প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর এখনই সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মোকাবিলা করতে হচ্ছে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপ দেশটিকে। এ বছর কলম্বোকে প্রায় ৬৯০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে, অথচ ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ছিল ২৩০ কোটি ডলারের মতো। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের এই দেশটির মানুষকে এখন প্রতিদিন ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে, কারণ জ্বালানি  তেল আমদানির মতো যথেষ্ট বিদেশি মুদ্রা দেশটির সরকারের হাতে নেই। দেউলিয়া হতে বসা শ্রীলঙ্কা সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে আর্থিক সহায়তা চেয়েছে। আইএমএফের একজন মুখপাত্র বৃহস্পতিবার বলেন, এ বিষয়ে তারা শিগগিরই কলম্বোর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। শ্রীলঙ্কার পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১৮.৭ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৩০.২ শতাংশে পৌঁছেছে। খবর অনুযায়ী, ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় গত মাসে শ্রীলঙ্কা তাদের একমাত্র তেল শোধনাগারটি বন্ধ করে দেয়। ডিজেল সংকট যত বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিংও তত বাড়ছে। বিদ্যুৎ না পাওয়ায় দেশটির প্রধান স্টক মার্কেটে লেনদেনের সময় কমিয়ে এনেও কাজ হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বাঁচাতে সড়কবাতিও নিভিয়ে রাখা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার ১৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। সামনের দিনগুলোতে এটি ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। ফলে বিঘিœত হচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। তেলের পাম্পগুলোতে লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। এমনকি রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানের সামনেও দেখা যাচ্ছে দীর্ঘ লাইন। গত সপ্তাহে এসব লাইনে দাঁড়িয়ে পাঁচজন বয়স্ক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ভেঙে পড়েছে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে দেশটিতে এখন শুধু হাহাকার।

যেভাবে বিপর্যস্ত অর্থনীতি : বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় ঠেকেছে যে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি ব্যয় পর্যন্ত মেটাতে পারছে না। জিনিসপত্রের দাম এখন আকাশছোঁয়া। কাগজের অভাবে দেশটির স্কুল পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কারণ কাগজ আমদানি করার মতো বৈদেশিক মুদ্রা তাদের কাছে  নেই।

জ্বালানি তেল সংগ্রহের জন্য হাজার হাজার মানুষ লাইনে ভিড় করছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পেট্রোল পাম্পগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে সরকার। এখানেও একই কারণ, জ্বালানি তেল আমদানি করার জন্য  বৈদেশিক মুদ্রা নেই শ্রীলঙ্কার কাছে। ইরানের কাছ থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ আড়াইশ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কা। এর বিনিময়ে প্রতি মাসে ৫ মিলিয়ন ডলারের চা ইরানে রপ্তানি করবে দেশটি। এভাবে ধীরে ধীরে টাকা পরিশোধ করা হবে।

পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন বলছে, গত ১৫ বছরে শ্রীলঙ্কা বেশ কিছু মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা ধরনের প্রকল্প রয়েছে। রাজধানী কলম্বোর কাছেই সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করে কলম্বো পোর্ট সিটি নামে আরেকটি শহর তৈরি করা হচ্ছে। এর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২৫ বছর এবং বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার। দাবি করা হয়, হংকং, দুবাই এবং সিঙ্গাপুরকে টেক্কা দেবে নতুন এই শহর। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে। বিপুল অর্থ খরচ করা হলেও অনেক প্রকল্পই অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়নি। এর মধ্যে অন্যতম হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দর। এসব প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।

গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলঙ্কায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন হয়নি। বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার ঋণ করার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। গত এক দশকে চীনের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা ঋণ নিয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। এ ঋণ দিয়ে বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করেছে। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন বন্ড ইস্যু করে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ঋণের অর্থ অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে এসব প্রকল্প থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যাচ্ছে না। চীন হচ্ছে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় ঋণদাতা। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মুদ্রা বাজার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের কাছ থেকেও ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এভাবে ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে উঠেছে দেশটি। অথচ সব মিলিয়ে চলতি বছরই শ্রীলঙ্কাকে প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, চলতি বছর এসব ঋণ কোনোভাবেই শোধ করতে পারবে না দেশটি। সর্বশেষ জানুয়ারি মাসে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে শ্রীলঙ্কা। ফলে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। যে কারণে দেশটি জ্বালানি তেল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না।

দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি বড় জায়গা-বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের পাঠানো ডলার। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারির সময় সেটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাষ্ট্রপতি রাজাপক্ষে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সে জন্য কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কায় সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কৃষিক্ষেত্রে। এতে চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে। এ অবস্থায় চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশটির চা উৎপাদনের  ক্ষেত্রেও। চা রপ্তানি করে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত, এরপর  সেখানেও বড় ধাক্কা লাগে। এদিকে কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে আনার জন্য সরকার ২০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। এর জেরে দেশজুড়ে খাদ্য ঘাটতিও প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষ করে উৎপাদন কমে যাওয়ায় গ্রামের কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হন। ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে এবং খাদ্য আমদানি করার জন্য আরও বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিই এ অবস্থার জন্য দায়ী। খোদ রাষ্ট্রপতির ভাই ও ভাতিজারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে আছেন। এটিও দেশটির এ অবস্থার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। আবার দেশজুড়ে মানুষ বিদ্যুৎ না পেলেও রাষ্ট্রপতি ও তার মন্ত্রীরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও সম্পদশালী, যা মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়ে তোলার কারণ। সূত্রমতে, বর্তমান সরকারের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদক্ষতাই পুরো পরিস্থিতির জন্য সরাসরি দায়ী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর