সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রমজানে বাজার ও আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রভাব পণ্যমূল্যে, রাজধানীতে ৯০ দিনে ৩৪ খুন

সাখাওয়াত কাওসার

রমজানে বাজার ও আইনশৃঙ্খলার চ্যালেঞ্জ

একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি- রমজানে এই দুই চ্যালেঞ্জ এখন সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। নিত্যপণ্যের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শসা, বেগুনের মতো কাঁচা সবজির দাম। দুধ, ডিম, মাংসের দাম বেড়েছে রোজার আগেই। বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা মাঠে নেমেছেন। টিসিবির ডিলার ও ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। সাশ্রয়ী মূল্যে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে রোজার প্রয়োজনীয় পণ্য। কিন্তু মধ্যবিত্তসহ বিপুল জনগোষ্ঠী এর সুফল পাচ্ছে না। বাজারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে। সন্ত্রাসী হামলা, খুন, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনাগুলো যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তবে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কমছে না।

রাজধানীর শাহজাহানপুরে ২৪ মার্চ রাতে দুর্বৃত্তরা ফিল্মি স্টাইলে খুন করে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুুকে। এ সময় সামিয়া আফনান প্রীতি নামের এক নিরীহ কলেজছাত্রীর নির্মম মৃত্যু হয়। এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ রীতিমতো ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ২৬ মার্চ বিকালে সবুজবাগের বেগুনবাড়ীর নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন মো. তানিয়া আফরোজ নামের গৃহবধূ। সব শেষ ২৭ মার্চ ভোরে দুর্বৃত্তদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন দন্তচিকিৎসক ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল। তিনটি ঘটনাই সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। জানা গেছে, রাতে জরুরি প্রয়োজন থাকার পরও নিরাপত্তার শঙ্কায় নগরবাসীর অনেকে বাসা থেকে বের হচ্ছেন না।

এ তো গেল মাত্র তিনটি ঘটনা। চলতি বছরের প্রথম ৯০ দিনে রাজধানীতে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। সারা দেশে এই সংখ্যা ৬২৮টি। নিয়মিতই ঘটছে ছিনতাই, অজ্ঞান-মলম পার্টির ঘটনা। তবে অভিযোগ রয়েছে, উল্টো হয়রানির ভয়ে বেশির ভাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিতও করতে চান না। অন্যদিকে কাল শুরু হয়েছে রোজার মাস রমজান। প্রতিবছর এ মাসে বেড়ে যায় মৌসুমি অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। তৎপর হয়ে ওঠেন ভেজালকারী ও খাদ্যদ্রব্যের মজুদদাররা। ইফতার, তারাবি ও সাহরির সময়কে পুঁজি করে তৎপর হয়ে ওঠে দাগি অপরাধীরা।

অপরাধ-বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বছর রমজানের আগেই তিনটি  রোমহর্ষক ঘটনা অনেক কিছুই জানান দিচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ হবে। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল কে এম আজাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘র‌্যাব সদস্যরা সব সময়ই দেশমাতৃকার জন্য সর্বোচ্চ ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করেন। আগাম গোয়েন্দাতথ্যের ভিত্তিতে অনেক ঘটনাই ঘটতে দেওয়া হয় না। অতীতের মতো এবারও রমজানকেন্দ্রিক আমাদের বিশেষ প্রস্তুতি রয়েছে। অপরাধীরা যাতে তৎপর না হতে পারে সে জন্য র‌্যাবের সব কটি ব্যাটালিয়নকে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। তারা নিজেদের মতো করে কৌশল নির্ধারণ করে প্রস্তুতি গ্রহণ করবে। ম্যাজিস্ট্রেট স্বল্পতার বিষয়টি উল্লেখ করে কর্নেল আজাদ বলেন, ‘দেখুন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্র্রেটের জন্য র‌্যাবে ১৩টি পদ রয়েছে। অথচ র‌্যাবে ম্যাজিস্ট্র্রেট রয়েছেন মাত্র তিনজন। আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্র্রেট আনার চেষ্টা করছি। তবে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী রমজানে ভেজালকারী ও মজুদদারদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি বাজার মনিটরিং এবং অভিযানের মধ্য দিয়ে নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিক রাখার জন্য র‌্যাবের প্রশংসা করেছেন।’ ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর (ডিএমপি) দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় খুন, চাঁদাবাজি, গাড়ি চুরি ও দস্যুতার মতো অপরাধ বেড়েছে। কমেনি ছিনতাইয়ের ঘটনাও। জানুয়ারিতে রাজধানীতে খুন হন নয়জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের ঘটনা ১২টি। এর মধ্যে পাঁচটি খুনের ঘটনাই মিরপুর এলাকায়। খুনের সঙ্গে ঢাকায় মোটরসাইকেলসহ গাড়ি চুরির ঘটনাও বেড়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এ রকম ৩৬টি ঘটনায় মামলা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চুরির মামলা হয়েছিল ৩১টি। চাঁদাবাজির ঘটনায় গত দুই মাসে ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৬টি। গত মাসে নয়টি ও জানুয়ারি মাসে সাতটি। তবে অনেকে হয়রানি এড়াতে এবং চাঁদাবাজদের হুমকির কারণে মামলা করতে চান না। একই ঘটনা ঘটে ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রেও। ছিনতাইয়ের ঘটনায় জানুয়ারি মাসে পাঁচটি ও ফেব্রুয়ারিতে আরও পাঁচটি মামলা হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে, করোনার কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় চুরি ও দস্যুতা কম ছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আগের মতোই রাজধানী কর্মব্যস্ত। এ ছাড়া ঢাকায় মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছে মাদকসেবীরা। এ বিষয়ে রমজান ও ঈদকেন্দ্রিক নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে কথা হয় পুলিশ সদর দফতরের উপ-মহাপরিদর্শক হায়দার আলী খানের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রোজার মাস এবং ঈদের জন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে পুলিশের সব কটি ইউনিটে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। তারা নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো মাঠে রয়েছে। রোজার প্রথম দিন গতকাল কারওয়ান বাজার পরিদর্শন করেন খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এ সময় তিনি পণ্যের দাম যাচাই করা ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী চাল ও মাংসের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন। ব্যবসায়ীদের কাছে তিনি জানতে চান, রংপুরে যে বেগুনের কেজি ১৫ টাকা তা ঢাকায় এসে কীভাবে ৫০ টাকা হয়ে যায়? জবাবে ব্যবসায়ীরা ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির বিষয়টি উল্লেখ করেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘কোথাও যদি চাঁদাবাজির কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তাহলে আমার নম্বরটি নিন। কোন কোন পয়েন্টে চাঁদাবাজি হচ্ছে আমাকে জানান। আমি নিজে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব।’ ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘খাদ্যদ্রব্য ও পণ্যের অবৈধ মজুদদার এবং ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের দুজন ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। অন্য কোনো সংস্থার অভিযান কিংবা ভ্রাম্যমাণ আদালতের জন্য আমাদের সহায়তা চাইলে আমরা তা দিতে প্রস্তুত।’ এ ছাড়া চাঁদাবাজিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেও হাইওয়ে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টি জানান তিনি।

কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘বরাবরের মতোই রোজার মাস ঘিরে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা থাকে। অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতো করে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাব নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য। এরই মধ্যে কমিশনার স্যার সব কটি ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। ইফতারের আগে ঘরে ফিরতে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ট্রাফিক বিভাগ তৎপর থাকবে। তারাবি ও সাহরির সময়ও থাকছে বিশেষ টহল। তবে আমাদের তৎপরতার বিষয়ে নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ফ্লাইওভারগুলো ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে পড়ে। ঢিলেঢালা টহলের সুযোগে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। অনেক সময় তাদের হাতেই প্রাণ ঝরেছে নিরীহ সাধারণ মানুষের। বাবুবাজার ব্রিজের দুই পাশের অনেক ল্যাম্পপোস্ট দীর্ঘদিন ধরেই নষ্ট। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ হয়ে ওঠে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এই অন্ধকারকে পুঁজি করেই দুর্বৃত্তরা সর্বস্বান্ত করছে সাধারণ পথচারীকে। সম্প্রতি রাজধানীতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ‘উড়ন্ত ছিনতাইকারী’ গ্রুপের সদস্যরা। তারা বেশির ভাগ সময় প্রতিটি থানার সীমান্ত পয়েন্টগুলোকে বেছে নিয়ে ওতপেতে থাকে। সুযোগ বুঝে টার্গেটে হামলে পড়ে। ছিনতাইয়ের পর খুব সহজেই তারা এক থানা থেকে আরেক থানা এলাকায় ঢুকে যায়। পুরো রাজধানীতে দুই শর বেশি ছিনতাই চক্র সক্রিয় রয়েছে বলেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এরা বিশেষ করে রাজধানীর খিলক্ষেত ওভারব্রিজ, উত্তরার দিয়াবাড়ী, পল্লবী, মোহাম্মদপুরের বোসিলা ব্রিজ, কাফরুলের শেওড়াপাড়া, সদরঘাট-বাবুবাজার ব্রিজের আশপাশ, মুগদা-মান্ডার বিভিন্ন গলি, কামরাঙ্গীরচর, গাবতলীর বেড়িবাঁধ, বংশাল, মাদারটেক, নন্দীপাড়াসহ বিভিন্ন নির্জন স্পটে সাধারণ মানুষের ওপর হামলে পড়ছে। পুলিশ বলছে, করোনার কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় চুরি ও দস্যুতা কম ছিল। তবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এখন আগের মতোই রাজধানী কর্মব্যস্ত। এ ছাড়া ঢাকায় মাদকসেবীর সংখ্যা বেড়েছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে চুরি, ছিনতাই ও দস্যুতার মতো অপরাধে জড়াচ্ছে মাদকসেবীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘অপরাধীদের তৎপরতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার পেছনে কভিডের প্রভাব রয়েছে। এর বাইরে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দরকার। নইলে টিপু হত্যার মতো আরও ঘটনা ঘটতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনের দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিতে হবে। নইলে আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির আশঙ্কা থাকবে। শুনেছি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট নেই। কর্তৃপক্ষের উচিত হবে এ বিষয়টির সুষ্ঠু সুরাহা করা।’

সর্বশেষ খবর