সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রশাসন ক্যাডারে নজর প্রকৌশলীদের

সর্বাধিক চাহিদার তিন ক্যাডারেই প্রথম প্রকৌশলী শিক্ষার্থীরা, সুরাহা হয়নি আন্তক্যাডার বৈষম্যেরও

উবায়দুল্লাহ বাদল

গত ৩০ মার্চ ৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করেছে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি)। এ ফলাফলে চাকরি-প্রার্থীদের সর্বোচ্চ চাহিদার প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থী। প্রশাসনে প্রথম হওয়া জান্নাতুল ফেরদৌস কুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে এবং পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হওয়া কাজি ফাইজুল করিম পাস করেছেন একই প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল ইসলাম পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন। তিনজনই প্রথম বিসিএসে নিজেদের পছন্দের ক্যাডার পেয়েছেন। বিগত কয়েকটি বিসিএসে বিশেষায়িতদের, বিশেষ করে ডাক্তার-প্রকৌশলীদের পেশাবদল ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। যেসব ক্যাডারে ক্ষমতা, সম্মান ও আর্থিক সুবিধা বেশি সেসব ক্যাডারে তারা যোগ দিচ্ছেন।

এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তক্যাডার বৈষম্যই এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী। প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির মূল্য, সম্মান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে অনেক বেশি। দেশসেরা মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তাররা কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে অবহেলিত। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ওপরে নানাভাবে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তারা। এসব কারণেই মূলত প্রকৌশলী ও ডাক্তাররা এবার প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেতে আগ্রহী হচ্ছেন। এরই প্রভাব দেখা যাচ্ছে সম্প্রতি বিসিএসগুলোর ফলাফলে। এর সঙ্গে পুরোই একমত প্রকৃচির (প্রকৌশলী-কৃষিবিদ-চিকিৎসক) কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. মো. ইহতেশামুল হক চৌধুরী। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আন্তঃক্যাডার বৈষম্যের কারণে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা (চিকিৎসক ও প্রকৌশলী) এখন টেকনিক্যাল ক্যাডার বাদ দিয়ে জেনারেল ক্যাডারে যাচ্ছেন। তারা বিসিএস পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ক্যাডারগুলোতে প্রথম হয়ে প্রমাণ দিচ্ছেন তারাই দেশসেরা মেধাবী। এর আগে বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিই দখল করেছিল ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়াররা। এর কারণ প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বেশি। তারা সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী হয়ে কেন দ্বিতীয় শ্রেণির ক্যাডারে যাবেন? এ বৈষম্য দূর করা না হলে ভবিষ্যতে দেশে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার খুঁজে পাওয়ায় মুশকিল হবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বিষয়টির সুরাহা করতে প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালে এবং ২০১৭ সালে নির্দেশনা দিলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে পেশাজীবীদের মধ্যে মারাত্মক অস্থিরতা চলছে।’

ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সিভিল সার্জন জানান, স্কুলজীবনের প্রতিটি ক্লাসে তিনি ছিলেন ফার্স্টবয়। তার যে বন্ধুটির রোল নম্বর ছিল ১৭, সে এখন প্রশাসন ক্যাডারের একজন যুগ্মসচিব। অথচ তার চেয়েও একধাপ নিচের পদের একজন উপসচিব (ডিসি) এখন আমার সমন্বয়ক। তার নির্দেশনায় কাজ করতে হয় আমাকে। একইভাবে উপজেলা পর্যায়েও উপজেলা ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করেন একজন ইউএনও। প্রশাসনিক যে মর্যাদা ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তাররা মেনে নিতে পারছেন না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এ বৈষম্য মেনে নিতে পারেনি বলেই তারা ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার হয়েও প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেতে আগ্রহী। তারা তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে নিয়োগও পাচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৩৫তম বিসিএস থেকে বিশেষায়িতদের, বিশেষ করে ডাক্তার-প্রকৌশলীদের পেশাবদল ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ৩৬তম বিসিএসে দুই হাজার ৩২৩ প্রার্থীকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে শতাধিক ডাক্তার, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদ নিজ পেশায় না গিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়েছেন। শতাংশের হিসাবে তা প্রায় ৪ দশমিক ৩০। ৩৭তম বিসিএসে এক হাজার ৩১৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। তাদের মধ্যে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণকারী প্রায় ৮০ জন অন্য ক্যাডারে সুপারিশ পান, যা মোট সুপারিশপ্রাপ্তের প্রায় ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। ৩৮তম বিসিএসে দুই হাজার ২০৪ জন প্রার্থীকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। সাধারণ ক্যাডারের ৬১৩ জনের মধ্যে প্রায় ১৭০ জন ডাক্তার-প্রকৌশলী-কৃষিবিদসহ বিশেষায়িত প্রার্থী। মোট ক্যাডার পদের হিসাবে এ হার ছিল প্রায় ৭ দশমিক ৭১ শতাংশ। এবারের ৪০তম বিসিএসে শুধু পররাষ্ট্র ক্যাডারেই নয়, প্রশাসন, পুলিশসহ আরও কিছু ক্যাডারেও ডাক্তার-প্রকৌশলীর আধিক্য রয়েছে। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার এবং বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা প্রকৌশলী নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছেন। অর্থাৎ বিশেষায়িত বিষয়ে পড়ালেখা করে চাকরি করতে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়। ডাক্তার-প্রকৌশলীই শুধু নন, কৃষিবিদরাও পেশাবদল করছেন।

প্রকৃচি নেতাদের দাবি, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে সব ক্যাডারে প্রথম গ্রেডের পদ সৃষ্টি, সুপারনিউমারারি পদোন্নতি ও পদসোপান তৈরির নির্দেশনা গত ১০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জুলাই অনুষ্ঠিত সচিব সভায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে সবার ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতি এবং পদায়ন নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল, তারপরও কোনো অগ্রগতি নেই। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর কাছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করাসহ ১৬ দফা বাস্তবায়নে স্মারকলিপি দেয় প্রকৃচি। ওই দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বাকি ২৫ ক্যাডারের সংগঠন বিসিএস সমন্বয় কমিটি। কিন্তু এর কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।

বিসিএস সমন্বয় কমিটির দাবি, আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা উপেক্ষা করা হচ্ছে। উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ের মতো সব ক্যাডারে সুপারনিউমারারি পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টির বিষয়ে ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রী সুষ্পষ্ট নির্দেশনা দেন। এর কার্যকর উপায় বের করতে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামকে প্রধান করে কমিটিও গঠন করা হয়। কমিটির জন্য তিন ক্ষেত্রে কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হলেও সুপার নিউমারারি পদোন্নতির বিষয়ে কোনো কাজই হয়নি। উপসচিব ও তদূর্র্ধ্ব পদে অব্যাহতভাবে সুপারনিউমারারি পদোন্নতির ব্যবস্থা চালু করে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি কেনায় সুদমুক্ত ঋণ প্রদান ও গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে আর্থিক সহায়তা দিয়ে বৈষম্য আরও বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ খবর