মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা
পর্যবেক্ষণ

পুলিশ বাহিনী থেকে ধর্মান্ধদের উৎখাত করতে হবে

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

পুলিশ বাহিনী থেকে ধর্মান্ধদের উৎখাত করতে হবে

লতা সমাদ্দার নামের অধ্যাপিকাকে কপালে টিপ পরার কারণে যে পুলিশ হেনস্তা করেছে তাকে চিহ্নিত করার জন্য ঢাকা মেট্রো পুলিশ, বিশেষ করে তেজগাঁও জোনের উপ-কমিশনার এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের অভিনন্দন। কারণ তারা একটি দুষ্কর কাজ সমাধা করে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। কমিশনার সাহেব যদি বলে থাকেন এই অপরাধীর বিরুদ্ধে শুধু বিভাগীয় তদন্ত হবে, তাহলে তাকে স্মরণ করিয়ে বলতে হয় এই অপরাধী বেশ কটি জঘন্য অপরাধ করেছে যথা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মারাত্মক জখম এবং এমনকি হত্যাচেষ্টা, যার জন্য এই ধর্মান্ধের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মামলা অবশ্যই করতে হবে। এ অপরাধী সংবিধান লঙ্ঘন করেছে, কেননা সংবিধানের একটি মৌলিক বিধান হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। শাড়ি, টিপ, চুড়ি, কাজল, কুমকুম অনাদিকাল থেকে বাঙালি মহিলাদের অনন্য ভূষণ, মর্যাদার প্রতীক, সম্মান, গৌরব এবং অহংকারের পরিচিতি, যা ছাড়া বাঙালি নারীর সাজসজ্জা অপূর্ণ থেকে যায়। কপালে টিপ বাঙালি কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার স্ত্রী সব সময় কপালে টিপ পরত, আমার সব নিকট আত্মীয় টিপ পরে বলে আমি গর্বিত। কেননা তারা বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি রক্ষা করছেন। গত বছর হিন্দুদের ওপর আক্রমণ তদন্তের জন্য ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং  জাতীয় সংসদের আদিবাসী ও সংখ্যালঘু বিষয়ক ককাসের যৌথ উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে জঙ্গি, মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে’ গঠিত গণতদন্ত কমিশনের সভাপতি হিসেবে আমি এবং কমিশনের অন্য সদস্যগণ ৯ মাসব্যাপী তদন্তকালে প্রমাণ পেয়েছি যে কিছু পুলিশ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা আক্রমণকারী জঙ্গিদের শুধু উসকানিই দেয়নি, সরাসরি তাদের সঙ্গে আক্রমণাত্মক কাজেও অংশ নিয়েছে, যা প্রমাণ করছে বেশ কিছু ধর্মান্ধ লোক পুলিশে ঘাপটি মেরে আছে, যাদের বিরুদ্ধে শিগগির কঠোর ব্যবস্থা না নিলে আমাদের হাজার বছরের সম্প্রীতির ইতিহাস, বাঙালির ঐতিহ্য এবং কৃষ্টি বিক্ষত হবে, যা আমরা হতে দেব না। এসব পুলিশের সংখ্যা খুব বেশি নয় বটে, কিন্তু অল্পসংখ্যক দুষ্ট লোকই অনেক অঘটন ঘটাতে পারে। আমাদের তদন্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি এই প্রতিবেদন দেখে ব্যবস্থা নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এরই মধ্যে চরমোনাই পীর নামে পরিচিত এক ধর্ম ব্যবসায়ী বিবৃতি দিয়েছে যে ভারতে হিজাব বন্ধ করা হলে বাংলাদেশে হিন্দুদের সিঁদুর-টিপ দিতে দেওয়া হবে না। দুঃখের বিষয় এই ধর্ম ব্যবসায়ীর কথা মারাত্মকভাবে অপরাধমূলক হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।          এভাবে কোনো বিশেষ লোক বা গোষ্ঠীকে ফৌজদারি অপরাধের দায় থেকে মুক্তি দিলে আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক নির্দেশনা ভেস্তে যেতে পারে।

যারা বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধী, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হওয়ায় যাদের বা যাদের পূর্বপুরুষদের বুকে রক্তক্ষরণ হয়েছে, যারা মন থেকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি সরাতে পারছে না, যারা ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান জয়ী হলে খুশি হয়, যারা খেলার মাঠে পাকিস্তানি পতাকা উড়ায়, যারা ভাস্কর্য ভাঙতে চায়, তারা বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলায় থাকতে পারে না। এ দেশে তারাই বসবাসের যোগ্য যারা বাঙালি ঐতিহ্য, কৃষ্টি এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যেসব ওয়াজ ব্যবসায়ী অন্য ধর্মের লোকদের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ সময়ের দাবি। তা না হলে আমাদের দেশে হাজার বছরের রক্ষিত সম্প্রীতি রক্ষা করা কঠিন হবে। এ সম্প্রীতি আমরা যে কোনো মূল্যে রক্ষা করব এবং এসব ধর্মান্ধকে অবশ্যই পরাজিত করব- এ অঙ্গীকার নিতে হবে। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এসব ধর্মান্ধকে মিলিতভাবে ধ্বংস করা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবার জন্য অপরিহার্য। লতা সমাদ্দারকে ধন্যবাদ তিনি সাহস করে বিষয়টি সবার নজরে এনেছেন। শুধু অপরাধী নজরুল তারেককে সাজা দিলেই চলবে না, পুলিশ এবং প্রশাসনকে ধর্মান্ধমুক্ত অচিরেই করতে হবে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর