বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রোজার মজা নষ্ট হয় ভার্চুয়াল নেশায়

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রোজার মজা নষ্ট হয় ভার্চুয়াল নেশায়

দেখতে দেখতে মাহে রমজানের চারটি দিন চলে গেছে। প্রতি বছরই রোজার শুরুতে মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। কি অপরূপ সে দৃশ্য। পৃথিবী তখন পৃথিবী মনে হয় না, জান্নাতের একটি টুকরো মনে হয়। তবে দুঃখের কথা, দিন যতই বাড়তে থাকে মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা কমতে থাকে। বিশেষ করে দু-চার দিন পর ধীরে ধীরে মসজিদ আগের দরিদ্র অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। আট-দশ রোজা পার হলে মসজিদ পুরোপুরি দরিদ্র হয়ে পড়ে।

মূলত এখনই শয়তান নতুন মুসল্লিদের মসজিদ থেকে ফেরানোর বিভিন্ন ফন্দি আঁটতে শুরু করে দিয়েছে। আবেগের বশে যারা মসজিদে এসেছিলেন তাদের আবেগের হাওয়া ফুরিয়ে এসেছে। তারপর জোর করে হয়তো আরও এক-দুই দিন নিজেকে মসজিদে আটকে রাখতে পারবে। কিন্তু প্রেম না থাকলে জোর করে কদিন চলে ভাই। একজন রোজাদারের জন্য এ সময়টা বড় নাজুক। এখন যদি সচেতন না হওয়া যায় তাহলে দু-চার দিনের ব্যবধানে রোজার সুঘ্রাণ সে হারিয়ে ফেলবে। তখন রোজার মজা সে আর উপভোগ করবে না।

আসলে রোজার মজা হারিয়ে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো ভার্চুয়াল ভাইরাস। মোবাইল, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া আসক্ত ব্যক্তি কখনই রোজার মজা পাবে না। প্রথম কয়েকদিন সে ভান করবে, রোজা রাখছি, মসজিদে যাচ্ছি, বেশ মজা পাচ্ছি। কিন্তু ভান বেশি দিন চালিয়ে নেওয়া যায় না। অল্প সময় পরই আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। তখন দেখা যায় আজান হয় মোবাইল আসক্ত ব্যক্তি আর মসজিদে ছুটে যায় না। মূল্যবান রাত কেটে যায়, ইবাদতে দাঁড়ানোর সৌভাগ্য তার হয় না। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। হে ভাই আমার! রমজানের যে অমূল্য রাতগুলো তুমি অহেতুক নেট ব্রাউজিং, চ্যাটিং, গেমিংয়ে কাটিয়ে দিচ্ছ, তোমার কি এতটুকুন আফসোসও হয় না! হায়! কীভাবে মরে গেল আমাদের চেতনা।

মুসলিম বিশ্বে দুর্ভাগ্যের ছায়া এমনি এমনি নেম আসেনি। জীবন থেকে রহমত, বরকতের ডানা আল্লাহতায়ালা এমনি এমনি সরিয়ে নেননি। বর্তমান প্রজন্মের বড় একটি অংশ রমজানকে সবচেয়ে ঘৃণ্যভাবে যাপন করছে। ইফতারের পর থেকে শুরু হয় মোবাইল চালানো। তারাবি, তাহাজ্জুদ, দোয়ার আসর, কোরআনের আসর কোনো কিছুতেই ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত ভাইটিকে পাওয়া যায় না। গা শিউরে ওঠার মতো খবর হলো, এমন হতভাগা তরুণও আমাদের দেশে আছে, রমজানের সারা রাত কাটিয়ে দেয় ইন্টারনেটের নোংরা দুনিয়ায়। আজানের ১০ মিনিট আগে কোনোরকম সাহরি খেয়ে পরদিন উপবাস পালন করে। এক ওয়াক্ত নামাজও পড়ে না! হায়! কে রটিয়ে দিল, না খেয়ে থাকলেই রোজা হয়ে যায়। কোরআনের নামে, নবীজির নামে এর চেয়ে বড় মিথ্যা আর কিছু হতে পারে কি? যেখানে নবীজি (সা.) নিজে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখে পাপাচার, ঝগড়া, মিথ্যা, অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকতে পারল না, তার না খেয়ে থাকায় আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই’; সেখানে কীভাবে না খেয়ে থাকার মধ্যেই রোজা সীমাবদ্ধ হয়ে গেল! আফসোস! না খেয়ে থাকা ব্যর্থ রোজাদারের জন্য! প্রিয় ভাই! সারা বছরই তো মোবাইলে বুঁদ ছিলে। এবার সময় এসেছে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ানোর। নোশাখোর যেমন রমজানকে নেশা ছাড়ার মাস হিসেবে গ্রহণ করে, তেমনি আমরা যারা ভার্চুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত, আমাদেরও রমজানকে গ্রহণ করতে হবে সুস্থ জীবনে ফিরে আসার মাস হিসেবে। বিষয়টি সহজ নয় কিন্তু সম্ভব। নিজের ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগান। মোবাইল চালানোর সময় নিজেকে প্রশ্ন করুন, এ আমি কী করছি! এতে আমার কী উপকার হচ্ছে! একজন নেশাখোর যেমন নেশা ভিতরে নেয় কিন্তু সে জানে না সে কী করছে, আমারও তো সে অবস্থাই হচ্ছে। নেশাখোর যেমন নেশাময় জীবন ঘৃণা করে কিন্তু নেশা থেকে বেরোতে পারে না, আমিও তো এভাবে সময় নষ্ট করাকে অপছন্দ করি, কিন্তু হাত থেকে তো মোবাইল রাখতে পারছি না। এভাবে নিজের সঙ্গে নিজে বাহাস করুন। আর পাঁচ মিনিট চালিয়ে মোবাইল রেখে দেব, আজ চালিয়ে নিই, কাল থেকে মনোযোগ দিয়ে ইবাদত করব, এসব প্রবোধ দিয়ে নিজেকে নিজে প্রতারিত করবেন না। কেউ আপনাকে ঠকালে আপনি রেগে যান, কিন্তু এই যে দিনের পর দিন নিজেই নিজেকে ঠকাচ্ছেন, এতে আপনার বিবেক কেন জেগে উঠে না!

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর